প্রতি বর্গফুট সাধারণ টাইলসের দাম ৮০ টাকা। একই পরিমাপের মার্বেল পাথরের টাইলসের দাম ৫৬০ টাকা। উচ্চমূল্যের এসব বিলাসী টাইলস ব্যবহার করা হচ্ছে ডাকঘরের নতুন ভবনে। তবে নির্মাণকাজ শেষ না হতেই বিলাসী মার্বেল পাথরের বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা গেছে। ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জ ডাকঘরের নির্মাণাধীন নতুন ভবনের। এছাড়া ময়মনসিংহ প্রধান ডাকঘরের নিচতলায় একটি বড় দেওয়ালের পুরো প্লাস্টার অস্বাভাবিক লবণাক্ত ও বিবর্ণ হয়ে গেছে। গুলশান ডাকঘরে আবার ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী।
Advertisement
৪৭৯ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি জিপিও ভবন, ২৪টি জেলা ডাকঘর, ৮টি উপ-ডাকঘর (স্থানীয় ডাকঘর), একটি সদর দপ্তর (সদর দপ্তরের ভবন ফিনিশিং ওয়ার্ক) এবং একটি ডাক জীবন বিমা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। চলমান ওই প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এসব মূল্যায়ন তুলে ধরেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
আইএমইডি বলছে, ‘ডাক অধিদপ্তরের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক ওই প্রকল্প চলমান থাকা অবস্থায় অনেক ডাকঘরের গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ অবকাঠামোর বেহাল দশা দেখা গেছে। এছাড়া চলমান প্রকল্পে ৫৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার টাকার অডিট আপত্তিও পেয়েছে আইএমইডি।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অধিকাংশ বড় ডাকঘরে সাধারণ টাইলসের বদলে মার্বেল ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ টাইলস ব্যবহার করলে সরকারের অনেক টাকা সাশ্রয় হতো। এরপরও অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণকাজের মান আশানুরূপ পাওয়া যায়নি।
Advertisement
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জে মেঝেতে স্থাপিত মার্বেল পাথরের বেশ কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা গেছে। নেত্রকোনা ডাকঘরের নির্মাণকাজ পরিদর্শনের সময় স্পষ্টতই একটি বিমের গাঁথুনিতে ‘সেগ্রিগেশন’ ও ‘ব্লিডিং’ এর প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা এর শক্তিকে আশঙ্কাজনকভাবে কমিয়ে দিতে পারে। কংক্রিট স্থাপনায় এটি একটি বড় ত্রুটি হিসেবে গণ্য করা হয়। ইটের গাঁথুনির মানও বেশ কয়েক জায়গায় খারাপ ছিল। ময়মনসিংহ প্রধান ডাকঘরের নিচতলায় একটি বড় দেওয়ালের পুরো প্লাস্টার অস্বাভাবিক লবণাক্ত ও বিবর্ণ হয়ে গেছে । একই সমস্যা আরও কিছু স্থাপনায় দৃশ্যমান ছিল। প্রায় সব নিৰ্মাণ স্থানে শাটারিংয়ের মান ভালো ছিল না। গুলশানে কংক্রিটের মান উন্নত পাওয়া গেলেও নির্মাণ সাইটে নিম্নমানের ইটের একটি বড় সম্ভার পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: সরকারি কর্মকর্তাদের ৬৮৪ ফ্ল্যাট নির্মাণকাজ নিয়ে অসন্তোষ আইএমইডির
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ডাক অধিদপ্তর। আএইমইডি’র প্রতিবেদন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক মো. আনজীর আহম্মদ বলেন, অডিট আপত্তি বা নিরীক্ষা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। এটার জবাব দেওয়া হচ্ছে। চলমান প্রকল্পে এক জায়গায় মার্বেলে রিপ্লেস হওয়া ফাটল দেখা যায়। ফাটল ঠিক করা হয়েছে। বৃষ্টির কারণে প্লাস্টার খসে পড়ে এটাও ঠিক হয়েছে। আইএমইডি’র অবজারভেশনে যা দেখা গেছে তা ঠিক করা হয়েছে। বড় কথা প্রকল্পটি এখনো চলমান। আমরা কিন্তু প্রকল্পটি এখনো হ্যান্ডওভার করিনি।
বিলাসী মার্বেল ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রকল্প পরিচালক কোনো উত্তর দেননি।
Advertisement
আইএমইডি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের নিরীক্ষা কার্যক্রমে মোট ১০টি অডিট আপত্তি ছিল। এর মধ্যে দুটি আপত্তির জবাব অডিট অফিসে দেওয়া হয় এবং বাকি ৮টি আপত্তির জবাব প্রকল্প পরিচালকের অফিসে প্রক্রিয়াধীন। আপত্তিগুলোতে সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার টাকা। নিয়ম অনুযায়ী কংক্রিট এবং স্টিল বারের শক্তি নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক রিপোর্ট পাওয়া গেছে। বুয়েট প্রদত্ত এসব রিপোর্টের ফলাফল সন্তোষজনক। তবে বেশ কিছু রিপোর্টে নমুনা ‘আনসিল্ড’ অবস্থায় থাকায় গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
আরও পড়ুন: কলেজের নির্মাণ শেষ হতেই উঠে যাচ্ছে আস্তর
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রকল্পের নকশা পর্যালোচনায় কিছু ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য লক্ষ্য করা গেছে। অধিকাংশ ডাকঘরের স্থাপত্য নকশা বেশ গতানুগতিক মনে হয়েছে। ই-কমার্স তথা পার্সেল সেবার জন্য আরও বড় স্থান রাখা, স্ক্যানার, কম্পিউটার ও নেটওয়ার্ক সেবার জন্য স্থান রাখা, পরিবেশবান্ধব ডিজাইন রাখা যেত। অধিকাংশ জেলা ডাকঘরে চার রুমবিশিষ্ট একটি গেস্ট হাউজ নির্মাণ করা হয়েছে। এটি বর্তমান বাস্তবতায় কতটা প্রয়োজনীয় তা যাচাই করা দরকার ছিল।
প্রকল্পে প্রাকৃতিক আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, সোলার প্যানেল ব্যবহার করা যেত বলে মত দিয়েছে আইএমইডি। পরিবীক্ষণ দলের এ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, বনানী ডাক জীবন বিমা সদর দপ্তর ভবনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করবেন।
এছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশব্যাপী বিস্তৃত এই প্রকল্পটি তদারকির জন্য ডাক অধিদপ্তরের প্রকৌশল শাখার লোকবলের অভাব একটি অন্যতম দুর্বল দিক। প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য পাঁচজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের সংস্থান থাকলেও কোনো বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়নি। কিন্তু নির্মাণকাজ সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য টেকনিক্যাল জনবল একান্ত আবশ্যক। কাজের মানের ক্ষেত্রে এটি নিশ্চিত প্রভাব ফেলছে। ফলে নির্মাণকাজ শেষে সার্ভিস ভালো না করতে পারলে বেসরকারি খাতে নিয়োজিত বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে।
আরও পড়ুন: নবনির্মিত কলেজের দরজা খুললে ভেঙে পড়ে ফলস সিলিং
আইএমইডি’র সুপারিশ
প্রকল্পটি ভবিষ্যতে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করেছে আইএমইডি। প্রকৌশল শাখায় লোকবল অপ্রতুল বিধায় যথাযথ তদারকির অভাব দ্রুত নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ, সম্ভব হলে স্থাপত্য নকশা উন্নত করা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস ও পরিবেশবান্ধব ডিজাইন নিশ্চিত করা, কিছু স্থানে দৃশ্যমান নির্মাণ ত্রুটির জন্য কারণ অনুসন্ধান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বলেছে আইএমইডি। ডাক অধিদপ্তরের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি উপযুক্ত কর্ম পরিবেশ ও সেবার মান কীভাবে বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়ার পরার্শ দিয়েছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
এমওএস/এমএইচআর/এসএইচএস/এএসএম