জাতীয়

অটোরিকশা-ইজিবাইক ‘ছিনতাই মানেই খুন’

গত এক দশকে দেশে ছিনতাইকারীদের হাতে শুধু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালক খুন হয়েছেন তিন শতাধিক। যাদের অধিকাংশ ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। খুনের শিকার অনেকেই আবার ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন অটোরিকশা ও ইজিবাইক। ফলে পরিবারগুলোকে স্বজন হারানোর শোকের সঙ্গে বয়ে বেড়াতে হয়েছে ঋণের বোঝাও। মূলত অর্থনৈতিক কারণে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইকের প্রতিটি যন্ত্রাংশ আলাদাভাবে খুব সহজেই বিক্রি করা যায় বলেই এসব যানবাহন ছিনতাইয়ে আগ্রহ বেশি ছিনতাইকারীদের। এ অবস্থায় সড়কে পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

Advertisement

২০২০ সালের ২২ আগস্ট দুপুরে ভাড়ায় চালানো ইজিবাইক (মিশুক) নিয়ে বের হয় ১৬ বছর বয়সী সানজিদ। রাত পেরিয়ে গেলেও ছেলে বাড়ি না ফেরায় পরদিন মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সানজিদের মা আঁখি আক্তার। প্রায় দেড় মাস পর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ওই ইজিবাইকের সন্ধান মেলে। খবর পেয়ে ইজিবাইকের মালিক স্বপন হোসেন ও তার আত্মীয়-স্বজনরা গোয়ালন্দ থানায় গিয়ে সেটিকে শনাক্ত করেন। এরপর ওই চোরাই ইজিবাইকের চালক আব্বাস শেখকে গোয়ালন্দ থানা পুলিশের সহায়তায় আটক করে শ্রীনগর থানা পুলিশ।

আব্বাস শেখের দেওয়া তথ্য মতে, হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাড়ে ৮ মাস পর শরিফ মন্ডল নামের এক আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার নিকড়া টিকারপুর নামক স্থানে সানজিদকে হত্যা করে ইজিবাইক নিয়ে যান শরিফ মন্ডল ও বিল্লাল। পরে সেটা বিক্রি করেন আব্বাস শেখের কাছে। ইজিবাইকের দাম ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ হলেও মাত্র ২০ হাজার টাকা দেন আব্বাস শেখ। তবে শরিফ মন্ডলকে গ্রেফতারের দুই মাস আগেই পুলিশ সানজিদের মরদেহের মাথার খুলিসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ছোট-বড় ৩৭টি হাড় পায়। একই সঙ্গে আকাশি রঙের অর্ধপচা জিন্সের প্যান্ট, কালো রঙের রাবারের বেল্ট উদ্ধার করা হয়। প্যান্ট-বেল্ট দেখেই সানজিদের মা তার মরদেহ শনাক্ত করেন। তবে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য মৃতের হাড় ও অঙ্গ-প্রতঙ্গ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। পাশাপাশি পরিচয় নিশ্চিত হতে করা হয় ডিএনএ পরীক্ষা।

সানজিদের মা আঁখি আক্তার বলেন, আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর অল্প বয়সেই ছেলেটা কাজে নামে। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। গাড়ি (ইজিবাইক) চালিয়ে যে টাকা পেতো তা দিয়েই কোনো মতে মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে চলতাম। ছেলেটাকে মেরে ফেলার পর থেকে অনেক কষ্টে চলছি এখন। একটা গাড়ি (ইজিবাইক) ছিনতাই করার জন্য জলজ্যান্ত মানুষকেই মেরে ফেললো!

Advertisement

মোটরসাইকেল ছিনতাই করতে বেসরকারি ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ইসমাইল হোসেন জিসানকে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা

ইজিবাইকের পাশাপাশি সিএনজি অটোরিকশা, উবার, পাঠাওয়ের গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তথ্য মতে, ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ছিনতাই-চুরিসহ খুনের ঘটনায় করা সূত্রহীন ৯১টি মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ৪টি, ২০১৬ সালের ৮টি, ২০১৭ সালের ৬টি, ২০১৮ সালের ১২টি, ২০১৯ সালের ১৯টি, ২০২০ সালের ২৪টি, ২০২১ সালের ১৪টি এবং ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪টি হত্যা মামলা বিপিআইয়ের কাছে এসেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩টি হয়েছে গাজীপুর জেলায়। এছাড়া ৫টির বেশি খুনের ঘটনায় মামলা রয়েছে ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ ও রংপুর জেলায়। এগুলোর মধ্যে ৪২টি মামলার তদন্ত শেষ করেছে পিবিআই। ৩২টি খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে তারা। ১০টি খুনের ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত হলেও অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারেনি সংস্থাটি। ফলে অভিযুক্তদের নাম ছাড়াই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তারা। এছাড়াও ৪৯টি মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এটি কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থার তথ্য। এ ছাড়া এমন হত্যার ঘটনায় ডিবি, সিআইডিসহ থানায় মামলা রয়েছে শতাধিক। তবে এসব মামলার তদন্তে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবহন ছিনতাই করতে গিয়ে খুন করেন ছিনতাইকারীরা।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত আইজিপি ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, সিএনজি অটোরিকশা ও ইজিবাইক চালক খুনের ঘটনা অধিকাংশই ছিনতাইয়ের জন্য হয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ অর্থনৈতিক বিষয়। অর্থের অভাব কিংবা পরিবহনগুলো ছিনতাই করে অর্থ আয় বা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। এক্ষেত্রে অর্থের পরিমাণটাও যে খুব বেশি তা নয়।

Advertisement

ইজিবাইক, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ছিনতাই-চুরির উদ্দেশ্যে গত কয়েকবছরে খুনের ঘটনা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ঢাকায় অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা উবার, পাঠাও চালকদের হত্যাও। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে পাঠাও। সেই থেকে গত ৬ বছরে একাধিক চালককে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে রাজধানীর উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন উবার চালক মো. আরমান। রাজধানীর মিরপুরে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন আরমান। এ ছাড়াও মোটরসাইকেল ছিনতাই করতে হত্যা করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র পাঠাও চালক ইসমাইল হোসেন জিসানকে। এরপর মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারে পাঠাও চালক মো. লিমনকে হত্যা করেন ছিনতাইকারীরা। বিগত কয়েক বছরে এমন আরও বেশ কিছু হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রাতে মালিবাগ ফ্লাইওভারে মিলনকে হত্যা করে তার মোটরসাইকেল ছিনতাই করা হয়

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যাটারি সহজে বিক্রি করা যায় বলে ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট আটোরিকশা ও ইজিবাইক। আলাদা করে বিক্রি হয় এর যন্ত্রাংশও। ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় পুরোনো ব্যাটারির দোকানে ইজিবাইকের ব্যাটারি বিক্রি হয় বলে জানা যায়। কম দামে বিক্রি হয় এসব ব্যাটারি। এসব হত্যাকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতাররা জানিয়েছেন দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক রয়েছে তাদের।

অটোরিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ঘটনাও যেন বাড়ছে। ফলে এসব ঘটনা থেকে প্রতিকারের উপায় খুঁজতে হবে আমাদের। এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির হয়তো ঘাটতি রয়েছে। যেসব রুটে বা স্থানে ছোটখাটো অপরাধ হয় সেটা চিহ্নিত করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়াতে হবে। এছাড়া কী কারণে এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান করা দরকার।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে যেকোনো অপরাধের বিচার করতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়। অপরাধ দমন করতে হলে শাস্তি যেন দ্রুত হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। না হলে অপরাধ কমবে না। ফলে যে কোনো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির পাশাপাশি অপরাধীর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

আরএসএম/কেএসআর/এমএস