মতামত

নগর কৃষি এবং ঘুম ভাঙার গান

এবিএম. বিল্লাল হোসেন

Advertisement

আমাদের দেশ আয়তনে ছোট কিন্তু ঘনবসতির দেশ| প্রতি বছর নদী ভাঙন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, মাটির ক্ষয় এসব কারণে বেশ কিছু ভূমি হ্রাস পাচ্ছে। আবার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসিক প্রয়োজনে আমাদের প্রতি বছর প্রচুর আবাদী ভূমি হারাতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবে আবাসিক প্রয়োজনে জমি ব্যবহৃত হতে থাকলে আগামী ৫০ বছরে আবাদী জমি শূন্যে নেমে আসবে।

প্রয়োজন মানুষকে বাধ্য করে বিকল্প খুঁজতে। এদেশে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ নতুন ভবন তৈরি হয়। সারা দেশে, সকল উপজেলা জেলা শহর, বিভাগীয় শহরসহ রাজধানীর সকল ভবনের আয়তন যোগ করলে কত পরিমাণ জমি হয়? এ পরিসংখ্যান সরকারের আছে কিনা জানা নাই, তবে, সহজেই অনুমান করা যায়, সকল ভবনের আয়তন যোগ করলে ছোট খাট একটা উপজেলার আয়তনের সমান হয়ে যাবে।

তো এতো বিশাল জনসংখ্যা, আবাদী জমি হ্রাস পেলে এতো মানুষের খাবার আসবে কোত্থেকে? মানুষের দরকার হবে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, কৃষিতে আসবে অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন। বর্তমান কৃষির ধারনা পালটে যেতে বাধ্য।

Advertisement

নগর কৃষি বা ছাদ কৃষির ধারণাটি অনেক পুরাতন হলেও এতোদিন খুব একটা প্রসার হয়নি, তবে গত কয়েক বছরে এখন সবার আগ্রহ বাড়ছে। এর প্রসার হচ্ছে। এর জন্য সোস্যাল মিডিয়ায় কিছু মানুষের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

ছাদ কৃষির উপযোগিতা:

১। তাপমাত্রা হ্রাস, দূষণরোধঃ

বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু উষ্ণায়নের ঝুঁকিতে। শহরায়ন মানে সবুজের সমাধি, ইট-পাথর-যানবাহন শিল্পকারখানা প্রভৃতি নিত্য তাপ ছড়িয়ে যাচ্ছে। শহর মানেই ঘনবসতি। শীতাতপ ব্যবস্থা, ফ্রিজার এসবের ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমন, তাপ ছড়ানো, যানবাহন কারখানার ধোঁয়া এসবে বায়ুদূষণ শুধু শহুরে জীবন না, এর প্রভাব দেশের জলবায়ুর উপর পড়ছে। তার প্রভাব কৃষি উৎপাদনে পড়ছে। অথচ শহর যদি সবুজায়ন হয়, নগর কৃষি যদি সমৃদ্ধ হয়, তো কিছুটা হলেও তাপমাত্রা হ্রাস পাবে, জাপানের টোকিও শহরের তাপমাত্রা কমানো গিয়েছে, আধুনা রাজশাহী শহরের তাপমাত্রাও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে মর্মে জানা যায়। উদ্ভিদ র্কাবন গ্রহণ করে, অক্সিজেন ত্যাগ করে। শীতে শহরের ধুলিকনা, গাছের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ফিল্টারিং হয়ে যায়।

Advertisement

২। জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণঃ গাছপালা মানেই পাখির আশ্রয়। সে কারণে জীববৈচিত্র্যর উন্নয়ন ঘটে। ছাদবাগানে পাখির আনাগোনা বাড়ে। মৌমাছি, প্রজাপ্রতিসহ নানা উপকারী পতঙ্গের আবির্ভাব ঘটে।

৩। রাসায়নিক/বিষমুক্ত চাষাবাদঃ

একজন নগর কৃষক মানেই সচেতন, শিক্ষিতজন। তিনি অর্গানিক চাষের মাধ্যমে বিষবিহীন শাক-সবজির উৎপাদন করতে পারেন। তাঁর মাধ্যমেই ভাল জাতের যেমন সম্প্রসারণ যেমন ঘটে, তেমনি তিনি অনেক বিরল জাত সংরক্ষণের প্রয়াস পান। আমাদের দেশে কীটনাশকের অপব্যবহার হয়, রাসায়নিক সারের অপচয় হয়।

৪। বিনোদন/মানসিক প্রশান্তিঃ

ছাদবাগানী গাছ ভালবাসেন, যখন তিনি বাগানে যত্ন নেন, তাঁর প্রিয় গাছটির সামনে আসেন, তখন তাঁর মনে একটা প্রশান্তি আসে। বিকেলের অবসরে একটুখানি সময় কাটাতে ছাদের এক কোনে বসার জায়গায় তিনি পরিবারের সবার সাথে সময় কাটাতে পারেন। আধুনা ছাদবাগানে বয়স্কদের পাশাপাশি এখন অনেক তরুণ/তরুণী এমনকি শিশু কিশোররাও ছাদ বাগানে আগ্রহী এবং তারা বাগানে সময় দেন।

৫। নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটায়ঃ

ছাদকৃষি হতে পারে একটা পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদার ভিত্তিতে। বাগানীরা নিত্য প্রয়োজনীয় মরিচ, লেবু, ধনেপাতা এসব যেমন নিজেদের বাগান থেকেই সংগ্রহ করেন, তেমনি তাঁর প্রয়োজনীয় প্রোটিনের চাহিদা ছাদ থেকে মেটাতে পারেন, এক পাশে কয়েকটি লেয়ার মুরগি পালন মানেই, ডিম আর মাংস।

এসবের বর্জ্য আবার বাগানে ব্যবহারের মাধ্যমে খরচ কমাতে পারেন। অনেকেই কিছু জায়গায় কবুতর পালন করেন। এটি একদিকে বিনোদন, অন্যদিকে প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। আবার দামী কবুতর পালন করে কেউ কেউ কবুতরের বাণিজ্যিক খামার গড়েন। ইদানিং কেউ কেউ ছাদে বায়োফ্লক্স পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে সফল হয়েছেন।

৬। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারঃ

আবাদহীন দেশের সকল ছাদে ছাদ কৃষির মাধ্যমে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। বাগানীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবদান যোগ করলে আমাদের জিডিপিতে এর কিছুটা হলেও অবদান যোগ হতে পারে।

৭। কর্ম সংস্থান:

দেশে ছাদ বাগান প্রসারের কারনে, অনেক তরুণ-তরুণী ছোট খাট নার্সারি করে ছাদ বাগানের গাছের চারা, জৈবসার, ইদ্যাদি বাগানীদের দৌড়গোড়ায় নিয়ে আসেন। তারা অনলাইনে কেনা বেচা করেন।

ছাদ কৃষির চ্যালেঞ্জ

১। বিজনেস অব এলোকেশনঃ

যতোদূর জানা যায়, এখন অবদি ছাদ বাগান কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। এর মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ কি কৃষি মন্ত্রণালয়, নাকি সিটি কর্পোরেশন করবে, না পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় করবে, অথবা রাজউক-চাউক ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠান করবে, তার কোন বিজনেস অব এলোকেশন ঠিক হয়নি। এটি নির্ধারণ হওয়া জরুরি।

২। উৎপাদনশীলতাঃ

এখানে আছে উৎপাদনশীলতার চ্যালেঞ্জ। মাঠ কৃষির মত সহজ না ছাদ কৃষি। কারণ যারা এ কৃষিতে আসছেন, তারা কৃষি কাজের মতো কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত নন। অতীতে যে মানুষটি কখনো কৃষি কাজ করেন নাই, তিনিই নগর কৃষক। তাছাড়া ছাদে তাপমাত্রা বেশি, ছাদ অনেক উঁচুতে থাকে বিধায় পরাগায়নে সহায়ক পতঙ্গের উপস্থিতি কম।

৩। নেতিবাচক ধারণাঃ

একটা প্রচলিত ধারণা যে, ছাদকৃষির কারণে ছাদ ডেমেজ হতে পারে, ডেঙ্গুর বিস্তৃতি ঘটতে পারে। মূল্যবান পানির অপচয় ইত্যাদি। অথচ, একজন ছাদবাগানীর মাধ্যমে ছাদ থাকে পরিচ্ছন্ন। বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার পাইপের মুখ বন্ধ থাকে না, কারন বাগানীর যত্নশীলতা। পানি জমে ছাদ স্যাঁত স্যাঁতে থাকে না, কারনণ বাগানীকে এসব পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। বাগানীর কারণে ছাদ ডেমেজ প্রতিরোধ হয়ে থাকে। বাগানের ড্রামে বা গাছের গোড়ায় কখনো পানি জমে থাকে না, কারণ পানি জমে থাকলে গাছ মরে যায়, সুতরাং জমানো পানি না থাকলে ডেঙ্গুর সম্ভাবনাই থাকে না।

৪। ছাদের মালিকানা ইস্যুঃ

একক মালিকানা হলে ছাদ বাগানে সমস্যা হয় না। তবে- এপার্টমেন্ট ভবনে একই ভবনের মালিক কয়েক জন থাকেন বিধায়, ছাদবাগানের মালিকানা নিয়ে সমস্যা, আবার মালিকদের অনেকে ছাদ বাগানে দ্বিমত পোষণ করেন। এসব নিয়ে ঝগড়া, মামলা ইত্যাদি ঘটে। ফলে অনেক বিনিয়োগের অপচয় হয়। বহু ছাদ বাগান বর্ণিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। সরকার যদি সকল ছাদবাগানকে একটা নীতিমালার আওতায় আনেন, তো এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সিটি কর্পোরেশন ভবনের মালিকের ট্যাক্স এ রিবেট দিচ্ছেন। এটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবে রিবেট দেয়ার বিষয়টি কতটুকু কাযকর হয়েছে, বিস্তারিত জানা যায়নি।

৫। ছাদবাগান ব্যয়বহুলঃ

ছাদবাগানে ব্যয় বেশি, কারণ মাটি, সার গাছ ইত্যাদি বহন করে উপরে উঠানো, শহরে ছাদবাগানের উপকরণগুলো খুব একটা সহললভ্য নয়, শহরে সার, কীটনাশক, মাটি-গোবর এসব সব এলাকায় পাওয়া যায় না। বাগানে বিশেষ প্রয়োজনে শ্রমিক পাওয়া দুস্কর।

পরিশেষে বলা যায়, এতো কিছুর পরেও শহরে দিনে দিনে ছাদ বাগানের প্রসার হচ্ছে। সরকারের গ্লোবাল ওর্য়াম ট্রাস্ট ফান্ড আছে। বাগানীদের সহায়তায় এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ছাদবাগানকে বাধ্যতামূলক করা এখন সময়ের দাবি। দেশের বরেণ্য উদ্যান তত্ত্ববিদদের মাধ্যমে ছাদ বাগানের ডিজাইনে নান্দনিকতা আনা প্রয়োজন। যাতে নাগরিকরা অবসরে বাগানে সময় কাটাতে পারেন। ভবিষ্যতে সকল সরকারি/বেসরকারি, ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোডে ছাদ বাগানের উপস্থিতি থাকা দরকার।

এভাবে পরিকল্পিতভাবে ছাদবাগানের প্রসার হলে, ভবিষ্যতে অনেক দেশ বাংলাদেশকে চিনবে, ছাদবাগানের দেশ হিসেবে। তাপমাত্রা কমে যাবে, বায়ুদূষণ অনেকাংশে লাগব হবে। নাগরিকরা শহরে সবুজ দেখতে পাবেন, দ্বিজেন্দ্রলালের বিখ্যাত গান, তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জাগে। আশা করা যায় একসময় নাগরিকরা কাকের ডাকে নয়, নানান পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙবে।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়।

এইচআর/এমএস