জাতীয়

‘গরুর মাংস খাওয়া বাদই দিয়েছি’

গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা। কোনো জায়গায় কিছুটা কমেও বিক্রি হয়। তাই গরুর মাংস খাওয়া বাদ দিয়েছি প্রায়। গরিবের খাবার ব্রয়লার মুরগিরও এখন ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট ইলিশ ৭০০ টাকা। সবচেয়ে কম দাম রুই-তেলাপিয়া, তাও এখন আড়াইশো থেকে তিনশো টাকার নিচে পাওয়া যায় না। কী খাবো?— জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই সংসারের ব্যয় ও নিজের দৈন্যদশার কথা জানান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শাহিনুর।

Advertisement

শুধু শাহিনুরই নয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সীমিত আয়ের মানুষের জন্য আগে দুবেলা ডাল, ডিম বা ব্রয়লার মুরগি ভরসা ছিল। হঠাৎ দামের ঊর্ধ্বগতি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে তাদের। ফলে জীবনযাপনে নানা কায়দার কথা ভাবছে মানুষ। বিশেষ করে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ছেন এ শ্রেণির মানুষ।রাজধানীতে বসবাস করেন এমন বেশ কয়েকজন শ্রমজীবী মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনযুদ্ধের গল্প জানার চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৮ বছর ধরে রিকশা চালান দিনাজপুরের মো. রেজাউল। ঢাকায় একাই থাকেন। পরিবারের বাকি সবাই গ্রামে। ১৮ বছর বয়সে ঢাকায় এসেছেন তিনি। ইচ্ছা ছিল জীবনমান পরিবর্তন করবেন। পেরেছেনও।

শুক্রবার (২৬ আগস্ট) টিএসসি এলাকায় জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় রেজাউলের। তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়সে ঢাকায় এসেছি, এখন ৩৬। সেই সময় থেকেই রিকশা চালাই। দুপুর ১২টার দিকে ঘুম থেকে উঠি। একটার দিকে বের হই। রাত ১২ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে আবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘুমাই। প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এর মধ্যে জমা দিতে হয় ১২০ টাকা। নিজের খাওয়া খরচ আছে ৪০০ টাকা। বাকি ৬০০ টাকা বা ৭০০ টাকা যাই থাকুক, বাড়ি পাঠিয়ে দিই।

Advertisement

কেমন আছেন সংসার নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আল্লায় ভালোই রাখছেন। পোলা স্কুলে যায়-আসে। ছোটটা ভর্তি হয় নাই।’ঢাকায় থাকতে কেমন খরচ হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যে গ্যারেজে রিকশা রাখি, ওই গ্যারেজেই ঘুমাই। কোনো টাকা লাগে না। কিন্তু পরিশ্রম করি, এ জন্য খাওয়ার পেছনে খরচ বেশি করি।’

দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসির দিকে মাথায় পাপড় ভাজা নিয়ে যাচ্ছেন হৃদয় খান। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। ঢাকায় দুবছর ধরে পাপড় ভাজা বিক্রি করেন।হৃদয় খান জানান, একদিনে সর্বোচ্চ ৪০০ পিস পাপড় ভাজা বিক্রি করতে পারেন। ১০ টাকা করে প্রতি পিস হলে, যার দাম হয় ৪ হাজার টাকা। তবে এ কাজে প্রতিদিন তাকে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা টানা হাঁটতে হয়। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কষ্ট করি। আল্লায় ভালোই রাখছেন।

রাজধানীর মতিঝিলে দিলকুশা রোডে ফুটপাতে বসে অল্প টাকায় খাবার খাচ্ছিলেন আরেক রিকশাচালক। ৪০ টাকায় ডিম-ডাল-ভাতের প্যাকেজ খাচ্ছেন তিনি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘খুব পরিশ্রম হয়। বড় হোটেলে তো দাম বেশি। তেলাপিয়া মাছ দিয়ে খাইলে ৫০ টাকা, রুই দিয়ে খাইলে ৬০ টাকা। তারও প্রতিদিনের আয় হাজার টাকা।’আরও পড়ুন>> সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্তরাজধানীর বাড্ডা আদর্শনগর এলাকায় বেশকিছু মোটরচালিত রিকশার দেখা মেলে। সেখানে একাধিক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। সেখানে রিকশাচালকদের অনেক জানান, প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার আয় করেন। অনেক আবার এর চেয়ে বেশি আয় করেন।

এত গেলো রিকশা চালকদের কথা। যাদের আয় হাজার টাকার মতো কিংবা তারও চেয়েও বেশি। যারা চাইলেই বিনে পয়সায় ঘুমোতে পারেন, কম টাকায় খেতে পারেন। চাইলেই পরিবার ঢাকার বাইরে রেখে নিজে ঢাকা থাকতে পারেন।কিন্তু ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন— দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কষাঘাতে জর্জরিত এমন মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তাব্যক্তির সঙ্গেও কথা হয় জাগো নিউজের।

Advertisement

বাড্ডা এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন জামাল হোসেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। বর্তমানে অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি— সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব অংক বুঝিয়ে দেন।

তিনি বলেন, করোনার আগে বিয়ে করেছি। করোনার প্রকোপ কমে আসায় স্ত্রীকে ঢাকায় নিয়ে আসি। ঘরে জমজ বাচ্চা। আগে বাড্ডা এলাকায় ১৪ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতাম। কিন্তু খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন ৮ হাজার টাকায় সাবলেট থাকি।করোনার পর একবার দুই হাজার টাকা বেতন বেড়েছে। কিন্তু জিনিসের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে ডাবল। বাসাভাড়া দিতে হয়, নিজের অফিসে যাতায়াত খরচ আছে, বাচ্চাদের তো চাইলেই ভাত খাওয়ানো যায় না। ওদের খরচ আছে। বাড়িতে বাবা-মাকে দিতে হয়। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে তো যেতেই পারি না। যে বেতন পাইতাম, তাতে ঢাকায় ব্যাচেলর থেকে বাড়িতে টাকা পাঠাইতাম। কিন্তু, ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকবো বলেই তাদের নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন দেখি যা খরচ, ঢাকায় থাকাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাড্ডা মাছ বাজারে কথা হয় আরেক মধ্যবিত্ত বেসরকারি চাকরিজীবী শাহিনুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাছের যে দাম ভাই, কী খাবো। তেলাপিয়া মাছ আগে খাইতামই না, এখন সেই মাছও বেশি দামে খেতে হচ্ছে। ঢাকায় স্ত্রী ও ছোট এক সন্তান আছে। মেডিকেল চেকআপ করাতে বাবা মাকেও ঢাকা এনেছেন। বেড়েছে খরচ।তিনি বলেন, গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা। কোনো জায়গায় কিছুটা কমেও বিক্রি হয়। তাই গরুর মাংস খাওয়া বাদ দিয়েছি প্রায়। গরিবের খাবার ব্রয়লার মুরগিরও এখন ১৮০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ছোট ছোট ইলিশ ৭০০ টাকা। সবচেয়ে কম দাম রুই-তেলাপিয়া, তাও এখন আড়াইশো থেকে তিনশো টাকার নিচে পাওয়া যায়। কী খাবো?

বাড্ডা আদর্শ নগর এলাকার একটি মেসে থাকেন রাসেল মিয়া। তিনিও মাছ দামাদামি করছিলেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে সপ্তাহে একবার গরুর মাংস খেতাম। এখন মেস ম্যানেজার বলে দিছে গরুর মাংস না কিনতে। কম দামে কী মাছ কেনা যায় তাই দেখছি। কিন্তু বাজারে তো সব কিছুরই দাম বেশি।

এমআইএস/এমএএইচ/