লালবাগ কেল্লা ঢাকার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। এটি রাজধানী ঢাকার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বংশাল থানার লালবাগ নামক জায়গায় অবস্থিত। লালবাগ কেল্লার প্রাচীন নাম ছিল ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’।
Advertisement
সেদিন লালবাগ কেল্লা দেখার জন্য রওনা হলাম মিরপুর থেকে। মিরপুর ১০ গোলচত্বর থেকে বাসে উঠে সোজা চলে গেলাম নিউ মার্কেট। সেখান থেকে রিকশাযোগে চলে গেলাম লালবাগ কেল্লার গেইটে।
প্রবেশপথেই দেখলাম টিকেট কাউন্টারে লম্বা ভিড় লেগে আছে। ভিড় ঠেলে টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম লালবাগ কেল্লায়। ভেতরে ঢুকেও লক্ষ্য করলাম প্রচণ্ড ভিড়।
তবে এখানে আসা দর্শনার্থীদের বেশিরভাগই তরুণ-তরুণী। দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে এখানে ঘুরতে এসেছে দেখে ভালো লাগলো। আমিও আপন মনে ঘুরছি আর ছবি তুলেছি।
Advertisement
জানা যায়, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র যুবরাজ আজম শাহ বাংলার সুবেদার হয়ে ১৬৭৮ সালে ঢাকায় আসেন ও তিনি কিল্লা আওরাঙ্গবাদ নামে একটি প্রাসাদ দুর্গ নির্মাণের কাজ হাতে নেন। তবে তিনি এই দুর্গ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পারেননি।
কারণ মারাঠাদের মোকাবেলার জন্য সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। ফলে তিনি দুর্গটির নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ঢাকা ত্যাগ করেন।
পরে ১৬৮০ সালে শায়েস্তা খান দ্বিতীয়বার বাংলার সুবেদার হয়ে ঢাকায় আসেন। তখন কেল্লার কাজটি পুনরায় শুরু হয়। তিনি এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন লালবাগ কেল্লা।
তবে কেল্লার কাজ শেষ না করতেই সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরিবিবি মারা যান। তাকে সেখানেই সমাধিস্থ করা হয়। আর এজন্য তিনিও এই কাজ শেষ করতে পারেননি।
Advertisement
লালবাগ কেল্লা দেশের অন্যতম এক দর্শনীয় স্থান। এর আয়তন ১৯ একর। লালবাগ কেল্লার যে ছবিটি বেশি ব্যবহৃত হয় তা পরীবিবির সমাধি। এটি চতুষ্কোণ আকৃতির। বিশাল আকৃতির তিনটি দরজা আছে।
এর ভেতর একটি দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। পরীবিবির সমাধীকে অনেকে আবার পরীবিবির মাজার বলে। এর ভেতরে আছে ৯টি কক্ষ। একটি গম্বুজও আছে, যা আগে সোনার ছিলো, এখন সেটি তামা দিয়ে মোড়ানো। এছাড়া দুর্গটির ভেতরে একটি বিশাল পুকুর আছে। যা এখন পানিশুন্য।
এখানে ঘুরতে আসা হোম ইকোনমিকস কলেজের শিক্ষার্থী বুসরাত জাহান বর্ষার বলেন, এখানে এসেছি মোঘল স্থাপত্যরীতির ইতিহাস জানতে। এসে ভালোই লাগছে।’
মানিকগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা সুজন মিয়া (৪০) নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমি ভ্রমণপিপাসু। সুযোগ পেলেই বের হয়ে যাই ঘুরতে।’
‘তবে লালবাগ কেল্লায় আজই প্রথম আসা। মোঘল স্থাপত্য যে এতো সুন্দর আজ জানলাম। এর আগে কখনো একই স্থাপনায় এতো কারুকার্যের ব্যবহার লক্ষ্য করিনি।’
লালবাগ কেল্লায় ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টিপাথর, মার্বেল পাথর আর নানান রং-বেরঙের টালি। লালবাগ কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো মোঘল ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন বৈচিত্র্যময় সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত।
লালবাগ কেল্লার ঢুকার পরেই লক্ষ্য করবেন সরু রাস্তার দু’পাশে নানারকম ঝাউগাছ আর পাতাবাহারের সারি। গোলাপ, গাদা, রঙ্গনসহ রয়েছে আরও বাহারি ফুলের গাছ।
সূর্য যখন হেলে পড়ে তখন লালবাগের আসল সৌন্দর্য চোখে ধরা পড়ে। যদিও আমি গিয়েছিলাম যখন সূর্য মাথার উপর। গরম-ক্লান্তি লাগলেও প্রকৃতি ও নিদর্শন দেখায় ভুলেই গিয়েছি গরমের কথা।
লালবাগ কেল্লায় শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ও দরবার হল বর্তমানে লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই দরবার হল থেকেই তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।
জাদুঘরে অনেক কিছুই রয়েছে দেখার মতো। মোঘল আমলের পাণ্ডুলিপি, মৃৎশিল্প, কার্পেট, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমানসহ আছে মোঘল আমলের বিভিন্ন সময়ের হাতে আকা ছবি যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
শায়েস্তা খাঁর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্রও সযত্নে আছে সেখানে। এছাড়া তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সে সময়কার প্রচলিত মুদ্রাও আছে জাদুঘরে।
এসব দেখতে দেখতে মাথার উপরের সূর্যটা হেলে পড়ে পশ্চিমে। ফেরার জন্য বের হওয়ার সময় কথা হয় লালবাগ কেল্লার টিকিট মাস্টারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই প্রায় ৪-৫ হাজার মানুষ ঘুরতে আসেন এখানে। বিশেষ বিশেষ দিনে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০-১২ হাজার’।
লালবাগ কেল্লা না ঘুরলে আপনার ঢাকা ভ্রমণ অসম্পূর্ণ হবে বলে আমি মনে করি। ৩০০ বছরের ঐতিহ্য কীভাবে এখনো টিকে আছে তার আপন মহিমায় এটা দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে আসতে হবে লালবাগ কেল্লায়।
কীভাবে যাবেন লালবাগ কেল্লায়?
নিউ মার্কেট থেকে রিকশায় চড়ে সরাসরি যাওয়া যাবে লালবাগ কেল্লায়। এছাড়া গুলিস্থান থেকেও রিকশায় আসা যাবে।
জাতীয় জাদুঘর শাহবাগের সামনে থেকেও বিশেষ বাসে যাওয়া যাবে লালবাগ কেল্লায়। এছাড়া ঢাকেশ্বরী থেকে মাত্র ১০ মিনিট পায়ে হাঁটলেও পৌঁছৈ যাবে লালবাগ কেল্লায়।
লালবাগ কেল্লার টিকিট কত?
লালবাগের মূল ফটকের বাইরে আছে টিকিট কাউন্টার। সেখান থেকে টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হবে। বাংলাদেশি দর্শনার্থীদের জন্য টিকিট মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা আর বিদেশিদের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। পাঁচ বছরের পর্যন্ত শিশুদের কোনো টিকেট লাগবে না।
লালবাগ কেল্লা খোলা-বন্ধের সময়সূচি
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে, আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
রোববার লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে। তবে সোমবার অর্ধদিবস কেল্লা বন্ধ থাকে। এছাড়া সব সরকারি ছুটির দিনে লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/এমএস