রাজধানীর ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা মেহবিশ জামান। পাঁচ বছর ধরে পেটের ব্যথায় ভুগছেন। বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ‘গ্যাস্ট্রো ইনটেস্টিনাল অ্যান্ড প্যানক্রিয়াটিক’ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. এম এস আরফিনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন মেহবিশ জামান। সম্প্রতি তার পেটব্যথা বেড়ে যায়। পরীক্ষা করে অগ্নাশয়ে সিস্ট (এক ধরনের টিউমার) ধরা পড়ে।
Advertisement
এরপর ডা. আরফিন অ্যান্ডোস্কপি করার পরামর্শ দেন। কিন্তু অ্যান্ডোস্কপি করার সময় একটি রক্তনালী থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলে রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। তাতে গুরুতর হয়ে পড়ে রোগীর অবস্থা।
পরিবারের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসার কারণে এমন অবস্থা হয়েছে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকরা বলছেন, এটি ‘কমপ্লিকেশন’ (রোগের কারণে জটিলতা) যা যে কোনো সার্জারির সময় হতে পারে।
শেখ মেহবিশের পরিবার জানায়, ডা. আরফিনের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘রোগীর অগ্নাশয়ে সিস্ট হয়েছে, যা অ্যান্ডোস্কপির মাধ্যমে অপসারণ করা যাবে।’
Advertisement
মেয়ের বাবা জসিম উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, অপারেশন থিয়েটারে না নিয়ে মেয়েকে অ্যান্ডোস্কপি ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ৩০ মিনিটের অপারেশন দুই ঘণ্টায় শেষ না হওয়ায় বিচলিত হয়ে পড়ি আমরা। তখন ডা. আরফিনের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন তার আইসিইউ প্রয়োজন।’
জসিম উদ্দিন আরও বলেন, এরপর ডা. আরফিন একই হাসপাতালের সার্জন ডা. মো. ইমরুল হাসান খানকে বিষয়টি জানান। তিনি আমাদের বলেন, ‘রোগীর রক্তনালী কেটে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে অপারেশন প্রয়োজন। রোগীর রক্তচাপ কমে যাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি বেড়ে গেছে।’
রোগীর বাবা অভিযোগ করেন যে, ছয়দিনে চিকিৎসা ব্যয় বাবদ চার লাখ ৫৭ হাজার টাকা বিল করা হয় এবং তা দিতে অনেকটা বাধ্য করা হয় তাদের। মেয়ের জীবনের কথা বিবেচনা করে টাকা দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেন শেখ জসিম।
এরপর বুধবার (২৪ আগস্ট) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ করেন মেয়ের বাবা শেখ জসিম। এছাড়া একই অভিযোগে আদাবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
Advertisement
পরের দিন বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগীর অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
এসময় অভিযুক্ত চিকিৎসক আরফিন বলেন, এমন একটা ঘটনার পর এটা স্বাভাবিক যে, পরিবার আমাকে অভিযুক্ত করবে- কি কারণে এমন হলো। দুর্ভাগ্যবশত এমন কিছু হয়নি, তারাও আমার কাছে আসেনি। ১৫ আগস্ট রোগী ডিসচার্জ হয়ে (হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে) বাসায় যান। এরপর একদিন ফলোআপে আসেন ডা. ইমরুলের কাছে। তারা আমার কাছেও আসেনি। তবে যেভাবে বিষয়টি প্রচার করা হচ্ছে, সেটির সঙ্গে আমাদের দ্বিমত রয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার অসুস্থতার উদাহরণ টেনে সার্জন ডা. ইমরুল হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল অধ্যাপক আরফিন তা নিয়েছেন। সার্জারি ছাড়া ম্যানেজ করার জন্য অ্যান্ডোস্কপি ছিল প্রথম অপশন। যদি সম্ভব না হতো তাহলে দ্বিতীয় অপশন ছিল ল্যাপ্রোস্কপি। তৃতীয় অপশন হচ্ছে কেটে করা। সবদিক বিবেচনা করেই প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ডা. আরফিন। এটা সাধারণ ব্যাপার যে, কোনো ইন্টারভেনশনালিস্ট ব্লিডিং শুরু হলে চেষ্টা করা, সেই ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা নিয়ন্ত্রণ করা। সেটি যথার্থভাবে করার চেষ্টা করেছেন ডা. আরফিন। তিনি যখন পারেননি, তখন আমাকে জরুরি ভিত্তিতে নিজের ফোন থেকে কল দেন।
ডা. ইমরুল হাসান বলেন, তখন আমি দ্রুত সেখানে যাই এবং গিয়ে আরফিন স্যারকে বলি যে, ব্লিডিং বন্ধ না করে আইসিউইউতে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। এরপর স্যারের অনুমতি নিয়ে রোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাদের থেকে অপারেশনের সম্মতি নেই। তারা আমাকে বলেন যে, ‘আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব করেন।’ আমি জানতে চাইলাম, রোগীর ব্লাড গ্রুপ কি। আমার ব্লাড গ্রুপ আর রোগীর ব্লাড গ্রুপ একই। সেখানে আরও দুজন তৈরি ছিলেন রক্ত দেওয়ার জন্য। সৌভাগ্যবশত রোগীর পরিবার রক্ত ম্যানেজ করতে পেরেছে। এরপর আমরা অপারেশন করেছি। এটাই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, সার্জারি করতে গিয়ে দেখেছি যে, মেজর কোনো রক্তনালী কাটা গেছে এমন কিছু না। এটি পাকস্থলীর গায়ে যেখানে ছিদ্র করা হয়েছিল, সেখানেই একটি সেল থেকে প্রচণ্ড ব্লিডিং হয়েছে। যার কারণে রোগী একরকম শকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের কারণে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। আমাদের কাছে খুব খারাপ লেগেছে যে, এইটুকু একটি মেয়ের সার্জারির প্রয়োজন হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি সার্জারির কমপ্লিকেশন আছে, সেটি ম্যানেজ করার সামর্থ্য আমাদের আছে। এটি সেরকমই একটি কমপ্লিকেশন যা আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি।
ডা. ইমরুল বলেন, আল্লাহর রহমতে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছে। মাইনর কিছু সমস্যা আছে, সেটি সার্জারির পর থাকবেই।
বিষয়টি দুর্ঘটনাজনিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই এটি অ্যাক্সিডেন্টাল। আমাদের কাছে কিন্তু পরিবারের অনুমতি দেওয়ার ফর্মটি আছে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আজকে যে সেব্রিনা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন আছেন, তারও একই ধরনের প্রক্রিয়ার কারণে ব্লিডিং হয়েছে। ফলে তিনি আইসিইউতে আছেন। আল্লাহর রহমতে আমাদের রোগীকে কিন্তু সেরকম কিছু হতে দেইনি। কমপ্লিকেশন হলেও আমরা ছেড়ে দেইনি, ম্যানেজ করেছি।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও সিইও আল ইমরান চৌধুরী বলেন, রোগী যেদিন ডিসচার্জ হয়, তখনও কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। ছয়-সাতদিন পর আমাদের কাছে তারা অভিযোগ জানালেন। যদি আর্থিক বিষয় হতো আমাদের তখনই জানাতে পারতো, তাও করেননি রোগীর বাবা। স্যারের টিমের ছয়-সাতজন সার্জারিতে কাজ করেন, তিনি তাদের কোনো চার্জ ধরেননি। সেখানে জীবন রক্ষা করাই প্রাধান্য ছিল। উনাদের যদি তখনও কোনো অভিযোগ থাকতো, আমাদের যে কাউকে বললেই আমরা গ্রহণ করতাম।
হাসপাতালের পরিচালক জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর তারা একটি তদন্ত কমিটি করে। বুধবার রাত ৮টায় তদন্ত শেষ করে কমিটি। তার জানায়, চিকিৎসায় কোনো প্রকার গাফিলতি হয়নি। এটি একটি কমপ্লিকেশন, যা সার্জারির কারণে হয়েছে।
এএএম/জেডএইচ/জিকেএস