জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সেবা কার্যক্রম নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। নামের বানান ভুল, ঠিকানা ভুল, তথ্যে গরমিল নিয়মিত ঘটনা। আর এসব ভুল সংশোধন করতে ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। ভোগান্তি ও হয়রানির তথ্য তুলে ধরে সম্প্রতি অনেক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) অভিযোগ দিতেও দেখা গেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এনআইডি সেবা কার্যক্রম ইসির কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিচ্ছে সরকার। যদিও এ পদক্ষেপ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে ইসি। এ কার্যক্রম পরিচালনা করবে মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনসহ সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এগিয়েছে অনেক দূর।
Advertisement
ইসির কাছ থেকে হস্তান্তরের পর একটি অনুবিভাগের মাধ্যমে এনআইডি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। কমিশনের কাছ থেকে এনআইডি সেবা নিজেদের কাছে নিতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০২২’ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে। এমন তথ্যই জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
গত বছর জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে নিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়। হস্তান্তর কার্যক্রম সম্পন্নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় তাদের মতামতে জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা কার্যক্রম ইসির কাছ থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে ন্যস্ত করতে বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হবে। এ পদক্ষেপ এগিয়ে নিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগ) ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে প্রধান করে একটি কারিগরি (টেকনিক্যাল) কমিটি গঠন করে সুরক্ষা সেবা বিভাগ।
Advertisement
এ বিষয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে এনআইডি সেবা পরিচালনার জন্য বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করতে হবে। আমরা আইনের খসড়াটি এরই মধ্যে প্রস্তুত করে ফেলেছি। আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে পারবো।
তিনি বলেন, আগের আইনটিই (জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০) মোটামুটি থাকছে। সংশোধিত আইনে এনআইডি সেবাদানকারী সংস্থা হিসেবে ‘নির্বাচন কমিশন’র পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
‘এখন পর্যন্ত একটি অনুবিভাগ গঠন করে এনআইডি সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চিন্তা-ভাবনা রাখছি আমরা। এ নিয়ে মিটিংও করছি। যেহেতু সরকারি সিদ্ধান্ত আছে, এ সেবা কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে আসবে, তাই আমরা চাচ্ছি এটি দ্রুত যেন বাস্তবায়ন করা যায়। সরকারি নির্দেশনার আলোকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।’
এনআইডি সেবা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে হস্তান্তরে সমন্বয়ের কাজ করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
Advertisement
এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শফিউল আজিম (আইন ও বিধি অনুবিভাগ) জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা সুরক্ষা সেবা বিভাগের কাছে হস্তান্তরের জন্য আইন সংশোধন অপরিহার্য। এজন্য আইনের খসড়াটি আমাদের এখান থেকে যাচাই করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বিধি-বিধানের সঙ্গে কোথাও কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, তা দেখে দেওয়া হয়েছে। এখন এটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনআইডি সেবা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি অনুবিভাগ গঠনের কাজ চলছে। গত ৭ আগস্টও এনআইডি সেবা অনুবিভাগ গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় পদ সৃজনের যৌক্তিকতা নির্ধারণের লক্ষ্যে সুরক্ষা বিভাগ সচিবের নেতৃত্বে সভা হয়েছে। রুলস অব বিজনেস সংশোধন প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যক্রমও চলমান।
এনআইডি সেবা কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগের হাতে এলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক সেবা ক্রমান্বয়ে যুক্ত হবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
গত বছরের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এক সপ্তাহ পর ২৪ মে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ উক্ত দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এনআইডি নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ওই চিঠিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ এর রুল ১০ অনুসরণে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০১০’ এ ‘নির্বাচন কমিশন’র পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্তকরণসহ প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়।
একই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ জুন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিজেদের কাছে রাখার বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় ইসি। চিঠিতে কমিশন জানায়, এনআইডির কাজ অন্য বিভাগে গেলে ভোটার তালিকা করা ও তা হালনাগাদ এবং নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমস্যা হবে। সরকারের এ পদক্ষেপকে তখন ‘সংবিধানবিরোধী’ বলেও আখ্যা দেয় কমিশন।
ইসির সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো পত্রের আলোকে সরকার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমতাবস্থায়, নির্দেশনাসমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
নির্বাচন কমিশন ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করে। ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার কার্যক্রমও পরিচালিত হয় ইসির মাধ্যমে। ২০১০ সালে ইসির অধীনেই এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।
এনআইডি সেবা কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে শুরু থেকেই ইসি বলছিল, যে কাজটি কমিশন করছে সেটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হলে নতুন জনবল ও অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। এতে খরচ হবে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়ে কমিশন নাগরিকদের ৩২ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ফলে এনআইডি সেবা কার্যক্রম কমিশনের হাতে থাকাই যুক্তিযুক্ত।
সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গত বছরের ২৯ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি কমিশনের হাতেই থাকা উচিত। তখন এক ব্রিফিংয়ে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের প্রতিক্রিয়া ছিল এমন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসির শুধু অঙ্গহানিই হবে না, এর মাধ্যমে কমিশনের কফিনে শেষ পেরেক যুক্ত হবে।
তবে এনআইডি সেবার দায়িত্ব থেকে নির্বাচন কমিশনকে বাদ দেওয়ার চিন্তা আগে থেকেই ছিল সরকারের। এক্ষেত্রে সরকারের যুক্তি ছিল, শুধু ভোটার নয়, এনআইডি হবে দেশের সব নাগরিকের জন্য। এছাড়া জাতীয় নিরাপত্তাসহ আরও অনেক কাজে এনআইডির ব্যবহার বাড়াতে চায় সরকার।
ইসি থেকে স্বরাষ্ট্রে এনআইডি সেবা হস্তান্তর নিয়ে দেশের একশ্রেণির মানুষের আশঙ্কা, যেহেতু ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে এনআইডি ব্যবহার করা হয়, ফলে ভবিষ্যতে এটিকে কেন্দ্র করে ভোটের ফলাফল প্রভাবিত হলেও হতে পারে।
আরএমএম/এমকেআর/এএসএ/এএসএম