রোহিঙ্গা সংকট পাঁচ বছর পার হয়ে ছয় বছরে পদার্পণ করল কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানকার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও রক্তপাত মিয়ানমারকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।
Advertisement
পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে। ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৪ জুন ২০২২ পঞ্চম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরুর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করা, তাদের নিরাপত্তা, জীবিকা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
১৯ জুন ২০২২ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচির আয়োজন করে। এর মাধ্যমে তারা তাদের সাত দফা দাবি তুলে ধরে ও মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানায় তারা।
Advertisement
জুন মাসে রুয়ান্ডার কিগালিতে কমনওয়েলথের অনুষ্ঠান চলাকালীন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিজাবেথ ট্রাসকে ১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাজ্য আসিয়ান ও জি৭ জোটের মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে মিলে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে বলে জানায়। ৪৮তম ইসলামী সহযোগী সংস্থার (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়েছে।
এশিয়ার ভবিষ্যৎ বিষয়ক ২৭তম আন্তর্জাতিক নিক্কেই সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ও এই সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা খুঁজে পেতে অবদান রাখতে এবং বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য এশিয়ার দেশগুলোর নেতাদের অনুরোধ করেন। রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য মিয়ানমারকে রাজি করাতে দক্ষিণ কোরিয়ার সহায়তা কামনা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আসিয়ানের সভাপতিত্ব গ্রহণ এবং মিয়ানমারে আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন, রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. নোলিন হাইজারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাখাইনে কর্মসূচি বাড়াতে অনুরোধ জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গেও আলোচনা অব্যাহত রেখেছে এবং ত্রিপক্ষীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে তবে এখন পর্যন্ত ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়া যায়নি। ৬ আগস্ট ২০২২, বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
Advertisement
বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে চীনের আরও জোরালো ভূমিকা ও প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চীনের সহযোগিতা চায়। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে প্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করে আসছিল ভারত।
১১ নভেম্বর ২০১৯ সালে আই সি জে তে গাম্বিয়ার করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ থেকে শুনানি শুরু হয়েছিল এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষ হয়। ২২ জুলাই, মামলার এখতিয়ার নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করার পাশাপাশি আইসিজে অভিযোগের বিষয়ে মিয়ানমারকে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিলের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এর ফলে এই মামলার বিচারপ্রক্রিয়া আবারও শুরু হলো।
আইসিজেতে করা মামলার বিচারকার্যের ওপর থেকে আপত্তি তুলে নিয়েছে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার (এন ইউ জি)। এন ইউ জি এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে বলে জানায়। ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে তাদের পরিচয়ের স্বীকৃতি দিয়ে এন ইউ জি ‘পলিসি পজিশন অন দ্য রোহিঙ্গা ইন রাখাইন স্টেট’ নামে একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে।
মিয়ানমারের রাজনীতিকদের ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে এভাবে কথা বলতে দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য এই গ্রহণযোগ্যতা রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তনের একটা ইতিবাচক অগ্রগতি। মিয়ানমারের রাজনৈতিক মহলে এবং আরাকানের স্থানীয় রাজনীতিতে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হলে সংকট সমাধান দ্রুত হবে।
যুক্তরাষ্ট্র আসিয়ানের সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে মিয়ানমারের সংঘাত অবসানের জন্য কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের জন্য পরিচালিত ‘যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায়’ ইউএসএআইডি ১৫ কোটি ২০ লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি অব্যাহত সমর্থন চলমান রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ২১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার বিষয়ে ওআইসি ও ই ইউ উপস্থাপিত ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর, জাতিসংঘে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এটা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই বহিঃপ্রকাশ। প্রস্তাবটিতে অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর, সেখানে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভয়াবহ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকায় দেশটির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর চার ধাপে এখন পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি ও ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল ইইউ। ইউরোপীয় কমিশন (ইসি) বাংলাদেশে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গা এবং মিয়ানমারের অন্যান্য সংঘাত-আক্রান্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তায় অতিরিক্ত ২২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চাপ প্রয়োগ করার জন্য ইইউর কার্যকর সমর্থন প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর মিয়ানমারের সাথে অধিকতর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য থাকায় তাদের দিক থেকেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ বজায় রাখা প্রয়োজন।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর ওপর থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ পর্যন্ত ১৩ দফায় সর্বমোট ২৯ হাজার ১১৬ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। সবমিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
জাপান ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাপান দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তার লক্ষ্যে ২০২১ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকের আলোকে এই সহায়তা দিচ্ছে জাপান। বাংলাদেশ জাপানের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অগ্রণী, সক্রিয় ও অর্থবহ ভূমিকা আশা করে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেওয়া উদ্যোগর প্রশংসা করেছে জাপান।
জাপান সরকার ডব্লিউএফপি এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে অতিরিক্ত আরও ৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেবে বাংলাদেশকে। জাতিসংঘ ও জাপানের পর এবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতাকারী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভাসানচরে যুক্ত হচ্ছে। ভাসানচরে এখনো জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের ওপর এককভাবে চাপ পড়ছিল। এই নতুন সহযোগিতার নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সেটা অনেকাংশে কমবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন করে ৭ কোটি মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার কথা জানিয়েছে। বিশ্বব্যাংক টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহায়তায় অনুদান হিসেবে ২৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ দেবে বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়ে এ সমস্যার মূল সমাধান প্রত্যাবাসনে জন্য আঞ্চলিক দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী ইউক্রেন ও আফগানিস্তান সমস্যার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা না কমানোর অনুরোধ জানানো হয়। প্রতি বছর ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে, জনসংখ্যার এই বাড়তি চাপ মোকাবিলা ক্রমেই মানবিক সহায়তার ওপর চাপ ফেলছে। ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে কাজ করার জন্য মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সাথে আগের চুক্তি নবায়ন করেছে। ফলে রাখাইনের প্রকল্পগুলোতে তারা কাজ শুরু করতে পারবে।
এন ইউ জি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি মা অং, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের বেশ কিছু আইন বাতিল করে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এন ইউ জি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য রাখাইন অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের জায়গা স্পষ্ট।
দুই জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে উভয় সম্প্রদায়ের নেতাদের এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। এই যোগাযোগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হবে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচারণার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়েছিল। রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও তাদের প্রতি সহনীয় মনোভাব ফিরিয়ে আনতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র যেমন কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা মিয়ানমারের বৌদ্ধ সংগঠনগুলোর মনোভাব নমনীয় করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মিয়ানমারের অর্থনীতিতে আঞ্চলিক অনেক দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তাদের বিনিয়োগ এবং চলমান বাণিজ্য সহযোগিতা মিয়ানমারকে পশ্চিমা বিশ্বের অবরোধ ও চাপ থেকে রক্ষা করছে এবং এর ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান প্রলম্বিত হচ্ছে। মিয়ানমারে বিনিয়োগকারী প্রথম সারির দেশগুলো হলো সিঙ্গাপুর, চীন, থাইল্যান্ড, মার্সাল দ্বীপপুঞ্জ, হংকং, সাউথ কোরিয়া, ইউ কে, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম এবং ভারত।
ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকে অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হলেও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকায় সামরিক সরকার পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। এই দেশগুলোর মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী অভিবাসী রোহিঙ্গাদের এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে।
আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারত, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক ও মানবিক সাহায্য প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আসিয়ান দেশগুলোর সাথে ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে মিয়ানমারকে সুসম্পর্ক রাখতেই হবে, তাই এই দেশগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং চলমান মানবিক সংকট মোকাবিলায় আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।
রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে সহিংসতা দেখে এসেছে, বাংলাদেশে তারা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায়। এখানে তারা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল এবং কর্মহীন। হতাশা রোহিঙ্গা যুবসমাজকে গ্রাস করছে এবং এই মানবিক সংকট বর্তমানে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সরকার দক্ষতার সাথে দীর্ঘদিন ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে ওঠেনি, যা প্রশংসার দাবি রাখে।
এই কর্মহীন জনগোষ্ঠী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা ধরনের অবৈধ ও নাশকতামূলক কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে এবং এই প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সংগঠিত নাশকতামূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা ক্রমাগত একটা দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান অস্থিতিশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সংকট স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হোক এটাই এখন কাম্য।
লেখক: ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম