মতামত

তারেক জিয়া, সিনহা ও কথিত আয়নাঘর

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা উঠলে তারেক রহমানের কথা আসবেই। আর এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো দিন। কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক দূরত্বকে রেললাইনের মতো সমান্তরাল করে রেখেছে। এই দিন বিরোধী দলকে গ্রেনেড মেরে নিঃশেষ করে দেওয়ার চেষ্টার ঘটনা। দিনটি স্মরণে ২১ আগস্ট আমি একটি পুরোনো ফেসবুক স্ট্যাটাস নতুন করে শেয়ার করেছিলাম।

Advertisement

সেখানে মূল কথা হচ্ছে, ২১ আগস্টের মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপি নেতা তারেক রহমান আদালত কর্তৃক স্বীকৃত খুনি। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন না করে, মানে নিজেকে খুনি নন প্রমাণের চেষ্টা না করে লন্ডনে পলাতক, যে শহরটি এখন দুনিয়ার সব পলাতক ক্রিমিনালদের স্বর্গরাজ্য বলে পরিচিত। আর ২১ আগস্ট ২০০৪ খালেদা জিয়ার শাসনামলের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দিন।

পোস্টে তারেক রহমানের মতো বড় মাপের একজন নেতাকে খুনি বললাম কেন সেই কারণে অনেকের মন খারাপ হয়েছে। আমার ওপর গোস্সা করেছেন। কেউ কেউ গালাগালি করে ব্লক উপহার পেয়েছেন।

খুনি বলার যুক্তি হিসেবে আমি বলেছি যে, আদালতের রায় অনুযায়ী তাকে খুনি বলছি, ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তিনি যদি দেশে এসে আইনের আশ্রয় নিয়ে খুনের দায় এড়াতে পারেন সেদিন আর খুনি বলবো না।

Advertisement

প্রকৃতপক্ষে আমি তারেক রহমান ছাড়া কোনোদিন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে কোনো নেতাকে কটুকথা বলিনি (মাঝে মাঝে জোকার আবাসিক নেতার কথা নিয়ে ট্রলে অংশ নিয়েছি সত্য)। আর রাজনীতিবিদদের কাজের সমালোচনা করার অধিকার তো সাংবাদিক হিসেবে নয় শুধু, জনগণের একজন হিসেবেও আমার আছে। কারণ তারা আমাদের শাসন করছেন বা শাসনকর্তা হতে চান। সে কারণে সরকার কিংবা বিরোধী দলের নেতাদের কাজের সমালোচনা করার অধিকার আমাদের সবার আছে।

সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের অধিকার-অনধিকার নিয়ে সচেতন নই। যে আমাদের শাসন করতে চায় তাকে আমরা বা তিনি কেউ সেবক মনে করি না, মুনিব মনে করি। ভাবি তার সমালোচনা মানে অনধিকার চর্চা, বেয়াদবিও। আমরা সিনেমার নায়িকা পরীমনির চরিত্রের বিশ্লেষণে পটু কিন্তু রাজনৈতিক নেতার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে জুজুর ভয়। অথচ পরীমনির চরিত্র বিশ্লেষণ করা আমাদের অধিকার নেই, তারেক রহমানের চরিত্র বিশ্লেষণ করার অধিকার আছে।

যাই হোক, সোশ্যাল মিডিয়ার বিএনপিপন্থি ভাইবোনরা আমাকে পাল্টা জবাবে বলেছেন যে, সরকারের নির্দেশে আদালত তারেক রহমানকে খুনি বানিয়েছেন। ২১ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততা নেই। তারা প্রায় প্রত্যেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিদেশে পলায়নের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যে, কথা না শোনায় শেখ হাসিনার সরকার তাকে দেশছাড়া করেছে। সুতরাং এই দেশের আদালত কেমন রায় দেন সবার জানা।

তারেক রহমানের মতো সিনহাও দেশের জন্য আরেকটা আপদ। তারেক রহমান বিএনপির সম্ভাবনাকে শেষ করছেন আর সিনহা উচ্চপদে সংখ্যালঘুদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ভীতি তৈরি করে গেছেন। তার দুর্নীতির ফিরিস্তি প্রথম প্রকাশ্যে আসে প্রখ্যাত সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের লেখায়, যার কারণে স্বদেশ রায়কে আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে।

Advertisement

তার বিরুদ্ধে আদালতের এই অন্যায়ের প্রতিবাদে আমি প্রথম কলাম লিখেছিলাম। কারণ একজন প্রধান বিচারপতি যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত সাকা চৌধুরীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে নৈতিক কারণে দেখা করতে পারেন না। সিনহার ওপর আমার শ্রদ্ধা তখন থেকেই শূন্যের কোঠায়।

একটি পত্রিকা হাউজের শীর্ষপদে চাকরির সূত্রে আমি সিনহার কিছু ঘুসের কাহিনিও জানতাম, যেগুলো পরে অভিযোগ আকারে মিডিয়া এবং আদালতে এসেছে। তা মোকাবিলা না করে সিনহাও পৃথকভাবে চার বছর এবং সাত বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে পলাতক। আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমানের মতো তিনিও বিদেশে বসে লম্বা লম্বা কথা বলেন।

সিনহার প্রতি বিএনপি-জামায়াতের প্রীতি দেখানোর বিষয়টি আমার কাছে বিস্ময়কর নয় শুধু, হাস্যকরও মনে হয়। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে সন্দেহ হয়।

সিনহা প্রধান বিচারপতি থাকাকালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়ে হিরো হতে চেয়েছিলেন। ৩ জুলাই ২০১৭ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বাংলাদেশের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তাকে অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদকে দেওয়া হয়েছিল। এই রায়ের ফলে সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত হয়, যার প্রধান হলেন প্রধান বিচারপতি।

তখন আমি আমার কলামে রায়ের সমালোচনায় বিএনপিকে সতর্ক করেছিলাম তাকে নিয়ে প্রীতি না দেখাতে। আমার কাছে ১৬তম সংশোধনীর রায় পড়ে মনে হয়েছে সেখানে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা ছিল সীমাহীন। প্রজাতন্ত্রকে অকার্যকর প্রমাণের শতচেষ্টা করা হয়েছে রায়ের পর্যবেক্ষণে। কিন্তু বিএনপি না জেনেই এই রায় নিয়ে সরকারের সঙ্গে সিনহার বিরোধ দেখে খুশিতে বাক্ বাকুম করেছে।

অথচ প্রধান বিচারপতি সিনহা এই রায়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বলে উল্লেখ করেছেন এবং বিদ্রুপ করে বলেছেন তারা ‘ব্যানানা রিপাবলিকের’ প্রতিষ্ঠাতা। এর শানে নুজুল কী? বিএনপি-জাতীয় পার্টি ‘অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের’ ‘অবৈধ সন্তান’?’ অন্যদিকে রায়ে সর্বমোট ‘শেখ মুজিব’ নাম উচ্চারিত হয়েছে ১১ বার। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে নয়বার। আবার রায়ের বয়ানে শেখ মুজিবকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনবার।

অথচ বিচারপতি সিনহা যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারে একের পর এক ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন দিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত তার তীব্র সমালোচক ছিল। রাজপথে আগুন, পেট্রলবোমা সন্ত্রাস করেছে। বলেছে রায়গুলো সরকার লিখে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় এরা ‘হিন্দুদের (মালা..) দখলে দেশ’ এমন একটি তালিকার শীর্ষে নাম রেখেছিল সিনহার। অনেকেই আনন্দের সঙ্গে সেটি শেয়ার করেছেন।

আমি বুঝি না, বিএনপির মতো এত গণসমর্থকপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দল কতটা আবোল-তাবোল পলিসিতে চলে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে সিনহার মতো চোর, অসৎ বিচারপতিকে সমর্থন করে।

অনেকে আমাকে এটাও বলেছেন, আপনি সবসময় তারেক রহমানকে কটাক্ষ করেন, খুনি বলেন, যদি সাহস থাকে ‘আয়নাঘর’ নিয়ে কথা বলেন। মানে ইঙ্গিত করছে সুইডেন থেকে পরিচালিত নেত্রনিউজ নামের একটি ওয়েবপোর্টালের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টের কথা, যেখানে দাবি করা হয়েছে ডিজিএফআই ‘আয়নাঘর’ নামে একটি গোপন জেলখানা চালাচ্ছে যেখানে অনেককে তুলে নিয়ে নির্জনকক্ষে বন্দী করে রাখা হয়, নির্যাতন করা হয়। এরমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে সেই রিপোর্ট যার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে তার একজন সাক্ষী, সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিজেই কর্মজীবনে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩ আগস্ট ২০২২ দাবি করেছেন যে, তারেক রহমানও ‘আয়নাঘর’র একজন ভিকটিম। তারেক রহমান অবশ্য সে দাবি করেননি এখনো কিন্তু তিনিও এই নিয়ে ভিডিও ছেড়েছেন দলীয় ইউটিউব চ্যানেলে। মির্জা ফখরুল বলার আগেই ফেসবুকে আক্রমণকারী বিএনপি সমর্থকদের আমি বলেছিলাম, সাহসটা তারেক রহমানকে দেখাতে বলেন। ভাঙা মেরুদণ্ড নিয়ে চিকিৎসার নামে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এখনো কেন আসেন না এবং কথিত আয়নাঘর নিয়ে কথা বলেন না। মালয়েশিয়া প্রবাসী এক শ্রমিকের বা সেনাবাহিনীর এক সাবেক কর্মকর্তার চেয়ে তারেক রহমানের বয়ানতো বেশি গুরুত্ব পাবে, বিশ্বাসযোগ্য হবে দেশে-বিদেশে। সাহস একা জনতা দেখাবে কেন তারেক রহমানও দেখাক, আয়নাঘরে তাকে নির্যাতনের কাহিনি বলুক, যদি সাহস থাকে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com

এইচআর/বিএ/জেআইএম