কৃষি ও প্রকৃতি

অনাবৃষ্টি-সেচ-সারে নাকাল কৃষক

# ৪০ বছরের মধ্যে দেশে সবচেয়ে কম বৃষ্টি# বিঘাপ্রতি বাড়তি খরচ হাজার টাকার বেশি# ৩০ শতাংশ জমিতে আমন চাষ কমেছে# ১২ লাখ টন চাল কম উৎপাদনের শঙ্কা# ১৫ দিন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দাবি কৃষিমন্ত্রীর

Advertisement

প্রকৃতির বৈরী আচরণ। আবহাওয়ার চরম বৈপরিত্য। বর্ষকালেও দেখা নেই বৃষ্টির। চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টির বছর পার করছে বাংলাদেশ। মাঠে ফসলের খেত ফেটে চৌচির। সেচ দেওয়ার জন্য সময়মতো মিলছে না বিদ্যুৎ। দাম বেড়েছে ডিজেলেরও। সিন্ডিকেটের কবলে সার। অনেক এলাকায় সারের তীব্র সংকট। বেশি দাম দিয়েও সার পাচ্ছেন না কৃষক। সবমিলিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতি পার করছেন দেশের কৃষকরা।

কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমন ধানের উৎপাদন কমছে। তার মধ্যে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আসন্ন বোরো মৌসুমেও ধানচাষে ভাটা পড়বে। সেচ-সারের অভাব ও বাড়তি খরচায় অনাগ্রহ দেখাবেন কৃষকরা। এতে ব্যাহত হতে পারে খাদ্য উৎপাদন।

তাদের মতে, আসন্ন বোরো মৌসুমেও ডিজেলের বর্তমান দাম বহাল থাকলে ধানের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়বে। কৃষকপর্যায়ে বাড়বে সেচ খরচ। প্রভাব পড়বে ধান কাটা, মাড়াই ও সরবরাহে। অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ায় লোকসান গুনতে হতে পারে কৃষকদের। আরও চড়া দামে চাল কিনতে হবে ক্রেতাদের, যা স্পষ্ট অশনিসংকেত।

Advertisement

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বন্যা ও খরার কারণে আমন আবাদ কমেছে। আসন্ন বোরো সেচনির্ভর হওয়ার কারণে জ্বালানি তেলের দাম বড় ফ্যাক্ট হয়ে দাঁড়াবে। অতিরিক্ত খরচের কারণে অনেক কৃষক ধানচাষে অনাগ্রহী হবেন। তারপরও যারা চাষ করবেন, তারা ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার শঙ্কায় থাকবেন। কৃষিকাজে খরচ বাড়ায় ভোক্তাকে বেশি দামে চাল খেতে হবে। সব মিলিয়ে চালের জন্য দারুণ দুঃসময় আসছে।’

সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ‘প্রায় ৩০ শতাংশ জমিতে এবার আমন চাষ কমেছে। বিগত আউশ মৌসুমেও ধানের উৎপাদন কম হয়েছিল। আসন্ন বোরো নিয়ে চিন্তা রয়ে গেছে। এ কারণে খাদ্য উৎপাদনের জন্য বড় আঘাত আসছে।’

বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান থেকে দেশে সবচেয়ে বেশি চাল আসে। বর্তমানে দেশে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশই আসে বোরো মৌসুমের ধান থেকে। ৩৯ শতাংশ আসে আমন ধান থেকে। বাকিটা আউশ থেকে আসে। ফলে চলতি আমন ও আসন্ন বোরোর উৎপাদন ব্যাহত হলে খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

কৃষকের যত খরচ বেড়েছেডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে দেশের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হয়, যা বিঘার হিসেবে দুই কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। একলাফে বেড়েছে ৩৪ টাকা, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ৪২ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।

Advertisement

এদিকে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, বিঘাপ্রতি জমিতে সেচ ও চাষ দিতে দরকার পড়ে ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের দাম বাড়ায় এ বছর সেচে কৃষকের বিঘাপ্রতি খরচ পড়বে ৬৮০ টাকা। পাশাপাশি মাড়াই, পরিবহনের কাজেও ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রেও খরচ বাড়বে বিঘাপ্রতি ৩৫০-৪০০ টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত খরচ পড়বে এক হাজার টাকারও বেশি।

অন্যদিকে শুধু বোরো মৌসুমে তিন কোটি দুই লাখ বিঘা জমির জন্য কৃষকের জ্বালানি তেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হবে ২০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ছয় টাকা বাড়ায় চলতি আমন ও পরবর্তী বোরো মৌসুমে চাল উৎপাদনে কৃষকের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ বাড়বে বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।

খাদ্য উৎপাদন কমার পূর্বাভাসযুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ। দু–তিনমাস পরপর সংস্থাটি বাংলাদেশবিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গত জুলাইয়ে তারা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। তবে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছর চালের উৎপাদন কমবে। তারা বলেছেন, চলতি মৌসুমে উৎপাদন হতে পারে তিন কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টন।

তবে দেশে চালের চাহিদা এর চেয়ে বেশি। এ কারণে প্রতি বছর কম-বেশি চাল আমদানি করতে হচ্ছে। রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সব ধরনের চাল মিলিয়ে আমদানি হয়েছে ১০ লাখ টন। এ বছর আমদানির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। উৎপাদন কম হলে আমদানি দুই থেকে চারগুণ বাড়াতে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষিমন্ত্রীও বলছেন উৎপাদন কমবেআমনের উৎপাদন কমতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বেশি। গ্রামগঞ্জে বেশিভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। সেচ সংকট তৈরি হয়েছে। আবার বন্যার কারণে আমন ধান দেরিতে লাগানো হয়েছে অনেক জায়গায়। এমন পরিস্থিতিতে সেচের অভাবে ধানক্ষেত ফেটে চৌচির। সেজন্য আমন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় এ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি বলেছি, ধানের উৎপাদন ব্যাপক কমে যাবে। আগামী ১৫ দিন আমনের সেচের কাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন।’

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আবহাওয়া বিভাগ বলছে, গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয়েছে এ বছর। শুধু বাংলাদেশে নয়, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে একই পরিস্থিতি। ফলে সেচ দিয়ে ধানচাষ করতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় সেচের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে।’

সেচ নিয়ে সমস্যা থাকলেও সার ঘাটতির বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চাহিদার অতিরিক্ত সারের মজুত রয়েছে। তারপরও কিছু ডিলার ও অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে দাম বাড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করছেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

চালের দাম বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা অনেক চতুর। তারা আমনের উৎপাদন কমবে জেনে চাল মজুত করছেন। এজন্য বাজারে চালের সরবরাহ কম। দামও বাড়তি।’

এনএইচ/এএএইচ/এমএস