মতামত

আয়ে শ্রীলঙ্কা ব্যয়ে সিঙ্গাপুর

দেশে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের দামও চড়া। গত জুন মাসের খবর অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর ঢাকা। এরপর তেলের দাম, বাস ভাড়া ও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম আরও একদফা বেড়েছে। এ শহরে মধ্যবিত্তদের বসবাস এখন দিনকে দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে সাধারণ দিনমজুর ও চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও নাজুক।

Advertisement

সরকারের দাবি, বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তাই দেশেও তেলের দাম বাড়াতে হয়েছে। কিন্তু ১৮ আগস্টের সংবাদ মাধ্যম বলছে, জ্বালানি তেলের দাম আট মাসে সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুদিন ধরেই ধাপে ধাপে জ্বালানি তেলের দাম কমে আসছিল। হঠাৎ দুই-একবার বাড়লে সেই অজুহাতে দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু এখন যে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম কমেছে সেটা নিয়ে কোনো কথা নেই।

আমাদের সব কিছুই সয়ে যায়। পেটে কিছু পড়ুক আর না-ই পড়ুক, পিঠে আমাদের সব কিছুই সয়ে গেছে। বাজারে সব কিছুর দাম চড়া এবং তা যথারীতি মেনে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তিও আমরা অর্জন করে ফেলেছি। করোনার দুই বছরে নিত্য পণ্যের দাম কোথায় এসে ঠেকেছে তা আমরা জানি। কিন্তু কোথায় তা ছিল তা আমরা বেমালমু ভুলে গেছি।

এতকিছুর ভেতর দিয়েও দেশ এগুচ্ছে। কিন্তু কোন দিকে এগুচ্ছে সে নিয়ে দেশে দুটি বিবদমান পক্ষ আছে। এক পক্ষ বলছে, দেশ সিঙ্গাপুর, কানাডা হয়ে গেছে। আরেক পক্ষের দাবি, দেশ শ্রীলঙ্কা হওয়ার পথে। আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতি ও টকশো’র বিষয়বস্তুও সিঙ্গাপুর-শ্রীলঙ্কা নিয়েই। কিন্তু সাধারণ মানুষের অবস্থা দুই দেশের মতোই। আমাদের আয় শ্রীলঙ্কার মতো, আর ব্যয় সিঙ্গাপুরে মতো। এ দুয়ের মাঝে পড়ে আমাদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা।

Advertisement

নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন-লাগা অবস্থার মধ্যেই আমরা শুনছি বিদ্যুৎ ও পানির দাম আরেক দফা বাড়তে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এর আগেও তাই হয়েছে। দেশে টাকা নাই। ব্যাংকে রিজার্ভ নাই। ট্যাংকে তেল নেই। দেশ চালাতে টাকা লাগে। তেল কিনতেও টাকা লাগে। সরকার তো আর নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে দেশ চালাবে না, আর সুইচ ব্যাংকের টাকায়ও দেশ চলে না। জনগণের টাকায়ই দেশ চলে। জনগণ থেকে দ্রুত টাকা তোলার উপায় হচ্ছে জ্বালানি তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ তথা ইউটিলিটির দাম বাড়ানো।

গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল বাড়িয়ে দিলে এক মাসের মধ্যেই তেলের রিজার্ভ ট্যাংক ও বিজার্ভ ব্যাংক দুটোতেই এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর আগে যতোবারই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, ততোবারই বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। কখনো কখনো হয়তো শুধু বিদ্যুতের দামই বাড়ানো হয়েছে।

তেলের দাম বাড়ায় নিত্যপণের বাজারে আগুন। সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় আছে দিনমজুর, চাকরিজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষগুলো। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন। সে কারণে তেল, পেয়াজ, চাল ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় রিকশাওয়ালারাও বিকশা ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক রিকশাওয়ালা ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই ভাড়া বেশি নেন কেন, রিকশাও কি তেলে চলে? তিনি বললেন, পেট খরচ বেড়েছে, তাই রিকশা ভাড়াও বাড়ছে। তার কথায় যুক্তি আছে। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। বাস ভাড়া বাড়তি, ডিমের দাম বাড়তি। সবাই সব কিছুর দাম বাড়াতে পারলে রিকশাওয়ালা কেন ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। তাকেও তো বাঁচতে হবে।

সবচেয়ে বিপদে আছেন চাকরিজীবীরা। ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়াতে পারেন, রিকশাওয়ালারাও রিকশা ভাড়া বাড়াতে পারেন। কিন্তু দেশের চাকরিজীবীরা চাইলেই তাদের বেতন বাড়াতে পারেন না। তারা অন্যের চাকরি করেন। এদেশের চাকরিজীবীদের বছর বছর বেতন বাড়ে না। যদি বাড়ে তা দিয়ে দ্রব্যমূল্যের ঘাটতি পোষানো যায় না।

Advertisement

মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে ইনক্রিমেন্টের কোনো সমন্বয় করার ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। তাই তারা দিনকে দিন প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সাধারণ চাকরিজীবীরা পেরে উঠছেন না। চাকরির বাজারও এতো বড় নয় যে চাইলে এক চাকরি ছেড়ে বড় বেতনের আরেক চাকরিতে যাওয়া যায়। চাকরিজীবীরা তাই দিনের পর দিন পেটের সঙ্গেই সমন্বয় করে চলেছেন।

এরই মধ্যে যদি বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানো হয় তবে মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী ও দিনমজুরদের জন্য এটি হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা বোর্ড। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ দাম কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু বোর্ডের এ সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আবাসিকে ২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ নিয়ে গত ১৪ বছরে অন্তত ১৫ বার পানির দাম বাড়ানো হলো।

ওয়াসা যদি পানির দাম বাড়ানোর আগে এমডির অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতো সেটি আরও ভালো হতো। যে এমডি আমেরিকা বসে অফিস করতে চান, মাসে সোয়া ৬ লাখের ওপর বেতন ওঠান, তিনি দেশের মানুষের ওপর বিলের বোঝা চাপাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

শুধু পানি নয়, বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর চিন্তা করছে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবি ৬৬ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। আর এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সুপারিশ করেছে ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর জন্য। পানি ও বিদ্যুতের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন দাম প্রস্তাব করছে। কেউ ৫০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করছে কেউ করছে ৪০ শতাংশ। জনগণের ওপর বিলের বোঝা কে কত বেশি আরোপ করতে পারে যেনো তারই প্রতিযোগিতা চলছে। এর মাঝে পড়ে জনগণের অবস্থা তথৈবচ।

সাম্প্রতিক জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে প্রথমে ১ ঘন্টার লোড শেডিং-এর কথা বলা হলেও এখন তা ঘণ্টায় ঘণ্টায় রূপ নিয়েছে। গ্রামে ও মফস্বলের অবস্থা বেশি খারাপ। দেশে বিদ্যুৎ নেই, কাজেই লোড শেডিং ছাড়া উপায়ও নেই। কিন্তু এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ দিতে না পারলেও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কথা ঠিকই ভাবছেন।

এদেশে কোনো কিছুর দাম বাড়লে তা আর কমার নজির নাই। আন্তজর্জাতিক কারবারী বা আমদানি -রফতানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী সবাই সবার পণ্যের দাম বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবনযাত্রার সমন্বয় করতে পারেন। সমন্বয় করতে পারেন না শুধু দেশের দিনমজুর ও চাকরিজীবীরা।

চাকরিজীবীদের মধ্য আবার সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন বেসরকারি চাকরিজীবীরা। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা বিভিন্ন সরকারি কাজের জন্য টেবিল খরচের একটা সমন্বয় করতে পারেন। যদিও সব সরকারি অফিসের কর্মচারিদের সে কপাল নেই। যাদের আছে তাদের রাজকপাল।

একদিকে দেশের একটি শ্রেণি অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দেশে বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ছেন, আরেকদিকে মধ্যবিত্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর নিম্নবিত্ত হচ্ছে আরও নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক। বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ালে উচ্চবিত্তদের ওপর এর প্রভাব যাই হোক না কেন, গরীব ও চাকরিজীবীরাই পড়বেন বিপদে। কাজেই, বিল বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি পুরণ না করে সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বেশির ভাগই হয়ে থাকে গ্যাস ব্যবহার করে। ২৫ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করে প্রায় ৫৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কাজেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়?

একদিকে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আরেকদিকে বছরের পর বছর ধরে সরকারি অফিস আদালতের বকেয়া বিল অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। সেসব অনাদায়ী বকেয়া বিল আদায় করলেও তো ঘাটতি পুরণ হতো। একজন চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত ভাড়াটের বিল দুই মাস বকেয়া থাকলে তিন মাসের মাথায় এসে লাইন কেটে দেয়া হবে আর সরকারি অফিস-আদালতের বিল বছরের পর বছর বকেয়া থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না এটা কেমন কথা?

গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্য মতে, সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে বকেয়ার বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ প্রায় ১৫১৭ কোটি টাকা। এই টাকা কি এখন জনগণ থেকে ওঠানো হবে? দেশে স্মার্ট ও প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, প্রিপেইড মিটার বসালে চুরি ও অনিয়ম অনেকটাই দূর হতে পারে। যদিও ডিজিটাল চুরির নতুন নতুন পথ বের করতেও আমাদের বেশি সময় লাগে না।

কাজেই, মধ্যবিত্তদের ওপর নতুন বিলের বোঝা না চাপিয়ে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করুন। এভাবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিল্প উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাজারের আগুন বেড়ে দ্বিগুন হবে। জনগণ তখন নিত্যপণ্যে হাতও দিতে পারবেন না।

সময় হয়েছে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সেবার অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলার ও কাজ করার। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ না হলে বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে এটাই স্বাভাবিক। দুর্নীতি-অপচয়-ব্যয় বন্ধ করে আয় বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ ও পানির দাম না বাড়িয়ে দুর্মূল্যের এ বাজারে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর ও চাকরিজীবীদের কথাও একটু ভাবুন।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক।

এইচআর/জেআইএম