বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয় সাড়ে সাতশোর বেশি পণ্য। একসময় রপ্তানিখাতে রাজত্ব ছিল পাট ও পাটজাত পণ্যের। গত প্রায় দুই দশকে পাটের সেই জায়গা দখলে নিয়েছে তৈরি পোশাক। চামড়া, কৃষিপণ্য, মাছ, হোম টেক্সটাইল, হালকা প্রকৌশল খাতেরও আছে অবদান। তৈরি পোশাকের নেতৃত্বে মূলত সাত পণ্য দখল করে রেখেছে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৯৪ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, রপ্তানির বাজার প্রসারিত করতে পণ্যে বৈচিত্র্য আনার বিকল্প নেই। দেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অপ্রচলিত পণ্যের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
Advertisement
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছর পণ্য রপ্তানি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি ছিল। পণ্য খাতে ৪৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার অর্জিত হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি।
করোনা মহামারির প্রভাব সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল বিশ্ব। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। ফলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে অর্থনীতিবিদরা আমদানি কমিয়ে রপ্তানির বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। এ লক্ষ্যে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে জোর দেওয়ার তাগিদ এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার তৈরি পোশাকে বিশেষ সুবিধা দিলেও রপ্তানি বহুমুখীকরণে বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছে না। এ কারণে ধীরগতিতে এগোচ্ছে দেশের অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বাজার।
পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের কদর বিশ্বজুড়েই। কৃষিপণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, পাট ও চামড়াজাত পণ্য দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে আন্তর্জাতিক বাজারে। সুনাম ও চাহিদায় ভাটা না পড়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরেও মোট রপ্তানি আয়ের ৯৪ শতাংশ এসেছে এসব পণ্য থেকে।
Advertisement
এর বাইরেও এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলো তুলনামূলক কম পরিচিত বা অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অপরিচিত। অথচ সেসব পণ্য থেকে রপ্তানি আয়ও একেবারে কম নয়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, বিগত অর্থবছরে সাইকেল রপ্তানি করে ১৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করেছে দেশীয় উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো, যা তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।
একইভাবে জনপ্রিয় খেলা গলফ ব্যাটের শাফ্ট রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ডলারের। ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এ পণ্যটির রপ্তানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। গত অর্থবছরে ২ কোটি ২৭ লাখ ডলারের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি হয়েছে। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬৬ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতের ইয়ার্ন ও ফেব্রিক্স বর্জ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি ডলারের। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ৫৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এসব পণ্যের বাইরে রপ্তানিতে অবদান রাখছে আরও শতাধিক পণ্য।
এর মধ্যে রয়েছে রক্ত নেওয়ার পাইপ, সি আর কয়েল, তামার তার, মাছ ধরার বড়শি, মশারি, শুকনা খাবার, খেলনা, আগর, ছাতার লাঠি, শাক-সবজির বীজ, নারিকেলের ছোবড়া ও খোল দিয়ে তৈরি পণ্য, ব্লেড, পাঁপড়, হাঁসের পালকের তৈরি পণ্য, লুঙ্গি, কাজুবাদাম, চশমার ফ্রেম, কৃত্রিম ফুল, পরচুলা, গরুর নাড়িভুঁড়ি, চারকোল ও টুপির মতো পণ্য।
এসব তুলনামূলক অপ্রচলিত পণ্য থেকে বার্ষিক রপ্তানি আয় কত, এর সুনির্দিষ্ট বা পৃথক কোনো হিসাব রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছে নেই। তবে ইপিবির বিভিন্ন সময়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছর অপ্রচলিত পণ্য থেকে আয় হয়েছে ২০ হাজার কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে এ আয় ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু পণ্য আছে যেগুলোর রপ্তানির পরিমাণ খুব বেশি নয়। আবার এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলোর রপ্তানির পরিমাণ প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় ভালো। এগুলোর মধ্যে কিছু পণ্যের চাহিদাও বিশ্বব্যাপী কম। তবে কিছু পণ্যের রপ্তানির বাজার অনেক বড়। এসব পণ্য রপ্তানিতে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে বৃহৎ বাজারে প্রবেশের সুযোগ থাকবে। যদিও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির ঝুড়িটি দিন দিনই বড় ও ভারী হচ্ছে। এতে কর্মসংস্থান বাড়ার পাশাপাশি আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রাও। অপ্রচলিত এসব পণ্যের বৈদেশিক বাজার প্রসারিত হলে দেশের মোট রপ্তানি আয়ে তা বড় প্রভাবক হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জাগো বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই রপ্তানি বহুমুখীকরণের কথা বলা হচ্ছে। তবে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। সুবিধা বা প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ খাতভিত্তিক। প্রচলিত রপ্তানি সহায়তা থেকে বের হয়ে উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক সহায়তা বাড়াতে হবে। তাহলে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বাজার বড় হবে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পণ্য বহুমুখীকরণে সরকার মুখে অনেক কথা বললেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না। ছোট উদ্যোক্তাদের অনেক সমস্যা পোহাতে হয়। কারখানা স্থাপন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বন্দরে ট্রেড লজিস্টিক্সের সমস্যা, রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন রকমের ট্যারিফ পলিসির কারণে ছোট উদ্যোক্তাদের প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে রপ্তানিপণ্যেও কাঙ্ক্ষিত বৈচিত্র্য আসছে না।
চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরে আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধিতে শুরু হয়েছে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি যাত্রা। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ইয়ার্ন ও ফেব্রিক্স বর্জ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত অর্থবছরের জুলাইয়ের তুলনায় এ বছরের একই সময়ে ১৫ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ প্রবৃদ্ধি হয়েছে পিভিসি ব্যাগ, প্রিন্টেড ম্যাটেরিয়ালস, পাল্প ও হস্তশিল্পে।
অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে পরিচিতি ইনসুলেটর তৈরি ও রপ্তানিতে ১৪০ কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে নিটল-নিলয় শিল্প গ্রুপ। এ বিনিয়োগ পেতে শিল্প গ্রুপটিকে সহায়তা করেছে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
এ বিষয়ে নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান আব্দুল মাতলুব আহমাদ জাগো নিউজকে বলেন, সুনামগঞ্জের ছাতকে আমাদের কারখানা স্থাপন করা হবে। সেখান থেকে বছরে ২শ কোটি টাকার ইনসুলেটর বিদেশে রপ্তানি হবে বলে আশা করছি। দেশের চাহিদা মিটিয়ে মিশর, নেপাল, ভুটান, নাইজেরিয়া ও কেনিয়া ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমরা ইনসুলেটর রপ্তানির কথা ভাবছি।
এ প্রসঙ্গে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পোশাক রপ্তানি করে বিশ্বজুড়ে আমরা পরিচিত ও সমাদৃত। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরেও এসেছিল ৮৪ শতাংশ। কিন্তু আমাদের এ রপ্তানি ঝুড়িটির বহমুখীকরণ করতে হবে। ছোট-বড় উদ্যোক্তারা বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, বিনিয়োগ পাচ্ছেন। এতে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের দ্বার যেমন খুলছে, রপ্তানি বাজারও প্রসার হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিডা ম্যাচ মেকিংসহ সব ধরনের সহায়তা করছে।
এসএম/এমকেআর/এএসএ/এএসএম