সময়টা সম্ভবত বেশিরভাগ মানুষের ভালো যাচ্ছে না। এর মধ্যে একের পর এক সহকর্মীর মৃত্যু সংবাদ। ২২ আগস্ট মারা গেলেন জিটিভির সাংবাদিক সুদীপ দে। এর আগের দিন একজন। এমন করেচলতি বছরই অনেকেই মারা গেলেন স্ট্রোক করে। এসব মৃত্যুকে আর স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া যাচ্ছে না। প্রথমত তাদের বয়স অল্প, দ্বিতীয় তো অনেকের মানসিক অবসাদ এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে, মৃত্যু যেন অবধারিত। কিন্তু এই যে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া এজন্য কি আমাদের তথাকথিত ‘বড় ভাই’, যারা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ শিখরে অগাধ ক্ষমতা নিয়ে বসে আছেন কিংবা সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের নামে নিজেকে রক্ষার ‘দোকান’ খুলেছেন তারা দায়ী নন?
Advertisement
টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, এমনিতে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা হয়ে উঠেছে কঠিন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, এ বছরের শুরু থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত অন্তত ১১৯ জন সাংবাদিক নানামুখী হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৩৮ জন পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার এবং ১৯ জন প্রকাশিত সংবাদের দায়ে মামলার শিকার হয়েছেন।
‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২২’ অনুযায়ী, ১০ ধাপ পিছিয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। এর মধ্যেও যারা পেশাটাকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছেন তাদের রয়েছে ঘরে বাইরে নানা চাপ। রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বাধা রয়েছেই, তবে মানসিকভাবে বেশি পর্যুদস্ত করে ফেলে অফিস পলিটিক্স।
সম্প্রতি আইজিআই গ্লোবালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ সাংবাদিক তাদের পেশা নিয়ে বিষণ্ণতায় ভুগছেন। পেশাগত হতাশার কারণেই সাংবাদিকতা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে চান ৭১ দশমিক ৭ শতাংশ সাংবাদিক। গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, পেশাগত অনিশ্চয়তায় সাংবাদিকতাবিমুখতার প্রধান কারণ। কেননা প্রায় ৮৫ শতাংশ সাংবাদিকই চাকরির অনিশ্চয়তায় ভোগেন।
Advertisement
হতাশার আরও কারণের মধ্যে রয়েছে, সময়মতো গণমাধ্যমে পদোন্নতি না পাওয়া, কম বেতন পাওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ। এসব হতাশা থেকেই অনেকে পেশা পরিবর্তন করেন। দেশ ছেড়ে চলে যান। বিশেষ করে মেধাবী সাংবাদিকরা এই পেশা ছেড়ে দেন। আর যারা মানসিক চাপ সহ্য করতে না পারেন, আয় ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পারেন বা অসংখ্য মানুষের প্রতিশ্রুতি শেষে প্রতারিত হন তারা সুদীপের মতো স্ট্রোক করে মারা যান।
সুদীপের উদাহরণটা এই কারণে আনছি সংবাদ সম্পাদনার পাশাপাশি, নিয়মিত উপস্থাপনা বা রেডিওতে অনুষ্ঠান করার কারণে ছিল পরিচিত মুখ। সবচেয়ে অবাক লাগে, সারাদিন অফিসে গ্রুপিং, কথা চালাচালি, নানা অপবাদ রটানো, মিথ্যার আসর বসানো, কার চাকরি খাবে এই চিন্তা, (কয়েকটি ব্যতিক্রম) এসব যেন প্রায় প্রতিটি মিডিয়ায় রুটিন ওয়ার্ক। অথচ সুদীপের জন্য মায়াকান্নায় অনেকের বুক ভেসে যাচ্ছে। তারা হয়তো জানেই না তারা হত্যাকারী, এই বোধটুকুও নেই।
এই প্রসঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরও যখন চাকরি হারালাম তখন দেখলাম মানুষের রূপ। যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা তো কথা রাখেননি। আর যারা নিয়মিত আদর যত্নের অভিনয় করতেন সেসব বড় ভাইরাও দেখলাম এক নিমিষে বদলে গেলেন।
দুঃসময়ে কাউকে পাশে পেলাম না। এখনো না। তাই বাধ্য হয়ে ‘পেটে-ভাতে’ চাকরি করা শুরু করলাম। এখনো সেটাই চলছে। জীবন তো চালাতে হবে। কারণ এটা সত্য যে এই পেশায় ‘বুড়ো বেশ্যা’ হলে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। মালিক আগেকার দিনের বাবুদের মতো বুঝে যান সে আর কোথায় যাবে?
Advertisement
যারা মিডিয়ার মালিক, যারা মিডিয়া চালান তারা অনেকেই আবার মিডিয়াকে দেখেন তাদের অন্য ব্যবসা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে। এতে নিজেরা বা তাদের প্রতি ভক্তিতে গদগদ থাকা কিছু সাংবাদিক লাভবান হলেও ক্ষতিতে থাকে বিশাল একটি অংশ। অথচ অবাক করার বিষয় হলো, এখনও তথ্য মন্ত্রণালয়ে সংবাদপত্র বা টিভির আবেদন জমা পড়ে আছে শত শত।
বাস্তবতা হচ্ছে, মালিকরা হয়তো ভালো আছেন। নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে কর্মচারীরা মাসের পর মাস বেতনহীনই থাকছেন। গার্মেন্টসেও কর্মী ছাঁটাই নীতিমালা আছে। শ্রম আইন আছে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো নীতিমালার তোয়াক্কা নেই। এসব কারণে হলফ করে বলা যাবে, সংবাদকর্মীদের বেশিরভাগই আজ অসুখী। প্রতিনিয়ত তাদের মাঝে টেনশন কাজ করে। এই বুঝি চাকরি হারাতে হলো।
এছাড়া হরহামেশাই কর্মী ছাঁটাই তো চলছেই। যারা পারছেন পেশা বদল করছেন, যারা মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না, তারা অনেকে ঢাকা শহর থেকে পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সন্তান নিয়ে কষ্ট আর কতটা সহ্য করা যায়। নিত্যপণ্যের দাম তো বেড়েই চলছে। এছাড়া বাসাভাড়া সময়মতো দিতে না পারলে কে থাকতে দেবে? অন্য পেশায় যেখানে দেখা যায়, অভিজ্ঞ ও মেধাবীদের মূল্যায়ন বেশি, এই পেশায় তার উল্টো।
বয়স হলেই চাকরি হারানোর আতঙ্ক। একজন মানুষের চাকরি হারানো মানে শুধু তার চাকরি হারানো নয়, তার সামাজিক মর্যাদা, দৈনন্দিন চলাফেরা—সর্বোপরি একটি পরিবার যেন পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ভাবতে হবে কেন একজন মেধাবী তরুণ এই পেশায় এসে হতাশায় থাকবেন, কেন পেশা ছাড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়বেন। একসময় একতা ছিল বলেই সরকার অন্যায় করতে ভয় পেতো। আর এখন থোড়াই কেয়ার করে। সেই একতাটা জরুরি।
এই পেশায় যে অঢেল অর্থ নেই সেটি সংবাদকর্মী মাত্রই জানেন। সেটিকে কেয়ার না করাই একজন সাংবাদিকের শক্তি। এরপরও পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু মালিকদের অতিলোভ, চাটুকার প্রবৃত্তি সেই প্রচেষ্টাকে আবারও নষ্ট করে ফেললো। অনেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হয়তো নিজেকে বদলে নিয়েছেন। কিন্তু যারা নীতি আর বেঁচে থাকার সঙ্গে আপস করতে পারেননি, তারা পেশা বদল করেছেন। কারণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলুন আর আদর্শিক লড়াই বলুন, ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তাটা আগে চাই।
এ যেন সুকান্তের প্রিয়তমাসু কবিতার কয়েকটি লাইনের মতো, ‘আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার’। এই অন্ধকার এতোই গভীর আর ধীরে ধীরে এতোটাই ঘনিভূত হচ্ছে যে, সহসা শেষ সুড়ঙ্গের পর আলোর দেখা মিলবে বলে মনে হয় না।
মৃত সুদীপের জন্য ‘মায়াকান্না’ দিয়ে শুরু করেছিলাম। সেটা দিয়েই শেষ করি। মিডিয়ায় সুদীপের মতো এমন অনেকে আছেন। যারা মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। সবসময় টেনশন! একটু ভালোভাবে বাঁচতে চেয়েও তথাকথিত ‘চাকরি দেনেওয়ালারা’ সেটা থাকতে দেবে না। ওরা ‘কাজ জানা’ লোক নয়, খুঁজবে ‘নিজের চামচা’। কাজেই ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে সুদীপের মতো একেবারে মরে যাওয়াই ভালো।
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক Shantanu.editor@gmail.com
এইচআর/ফারুক/এএসএম