কৃষি ও প্রকৃতি

দেশে ফিরে মিশ্র ফলের বাগানে কোটিপতি মাফি

দেশে ফিরে মিশ্র ফলের বাগানে কোটিপতি মাফি

ফরিদপুর সদর উপজেলার বিদেশফেরত যুবক মফিজুর রহমান মাফি (৩৮)। মিশ্র ফলের বাগান করে একবছরে তিনি ৬ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় করেছেন। ফরিদপুরের সদর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের হাটগোবিন্দপুর গ্রামে ১০৩ বিঘা প্রায় ৩৪ একর জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের মিশ্র ফলের বাগান। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের চারা বিক্রি করে তিনি আয় করেছেন এক কোটি তিন লাখ টাকারও বেশি।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সফল কৃষক মফিজুর রহমান মাফি একজন কৃষক পরিবারের সন্তান। তার পিতা কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের হাট গোবিন্দপুর গ্রামের কৃষক মো. আক্কাস আলী সরদার। পড়াশোনায় মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে না পেরে ভাগ্যের অন্বেষণে কুয়েত গিয়েছিলেন মাফি। সেখান থেকে কিছু টাকা উপার্জন করে কয়েকবছর পর দেশে এসে কিছু করার চেষ্টা করেন।

এরপর ভূষিমাল, রাখিমাল ও গরুর ব্যবসা করে একপর্যায়ে ব্যবসায় বেশ লোকসানের মুখে পড়ে কাশ্মীরি কুল চাষের মাধ্যমে তার এই বাগান করা শুরু। এ কাজে তার ছোট ভাই রিয়াজ সরদারসহ আরও প্রায় ৩০ জনের মতো নারী-পুরুষ কাজ করছেন। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদেরও কর্মসংস্থান হয়েছে।

মিশ্র এই ফল বাগান থেকে কোটি টাকা আয় করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। মফিজুর রহমান মাফির এই মিশ্র বাগানে এখন প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার বিভিন্ন জাতের দেশি-বিদেশি ফলের গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার কুল, ৩২০০ পেয়ারা, ১২০০ আম, মাল্টা ১২০০, ৭০০ কমলা, ১৮০০ লেবু, ৩২০০ ড্রাগন, ৩০০০ পেঁপে, ৩০০ শরিফাসহ আরও অন্যান্য ফলের গাছ রয়েছে।

Advertisement

তার এই মিশ্র ফলের বাগানে রয়েছে বিদেশি প্রজাতির সুমিষ্ট আম কিউযাই, কিং অব চাকাপাত, মিয়াজ্যাকি, চ্যাংমাই, রেড আইভরি, ব্রুনাই কিং- ৫ কেজি। এর প্রতিটি আমই পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং বেশ দামি। এছাড়া দেশি প্রজাতির বারি-৪, গৌড়মতি, ব্যানানাসহ বিভিন্ন প্রজাতির আম গাছ রয়েছে তার এই বাগানে। রয়েছে থাইল্যান্ডের বারোমাসী পেয়ারা গাছ।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফলের বাগান তৈরির পাশাপাশি মাফির বাগানে তিনি বিভিন্ন গাছের চারাও তৈরি করছেন। গত ১ বছরে তিনি কুল, পেয়ারা ও আমের ২ লাখ ৩১ হাজার চারা বিক্রি করে আয় করেছেন ৩৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। গত বছর শুধু কুলের চারাই বিক্রি করেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার। যা থেকে তিনি পেয়েছেন ২৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

এরপর চলতি বছরে কুল, পেয়ারা, আম, লেবু, শরিফা, মাল্টা, ড্রাগন ও কমলার ৪ লাখ ৪৫ হাজার চারা বিক্রি করে পেয়েছেন ১ কোটি ৩ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। গত বছর তিনি ফল গাছের জন্য ৩৫ লাখ টাকা এবং চারা উৎপাদনে ৪৬ লাখ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন।

মফিজুর রহমান মাফির এই ফলের বাগান করার অভিজ্ঞতা খুব বেশি দিন আগের নয়। পারিবারিক পেশা কৃষিতে মনোনিবেশ করে ২০১৯ সালে তিনি পৈত্রিক ১০ বিঘা জমি সঙ্গে আরও জমি লিজ নিয়ে ১৬ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন নাহিদ অ্যাগ্রো নামে এই বাগান। তৎকালীন উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার পরামর্শে তিনি বাগানে কাশ্মীরি কুল, আম ও পেয়ারার চারা লাগিয়ে একটি মিশ্র বাগান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তিন বছরের মধ্যে এখন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রকমের ফলের গাছ শোভা পাচ্ছে তার বাগানে।

Advertisement

শুরুর বছরে তিনি তার এই মিশ্র ফলের বাগানের সামনের অংশের সাত বিঘা জমিতে তিনি ভারত থেকে সংগ্রহ করে আনা ১৮৬০টি কাশ্মীরি কুলের চারা লাগিয়েছিলেন। তাতেই বাজিমাত করেন। প্রথম বছরে তিনি শুধু কাশ্মীরি কুল থেকেই আয় করেন ৬০ লাখ টাকা। শুরুর বছরে বাগানে বিভিন্ন গাছ রোপণ ও অন্যান্য খরচ বাবদ তার ব্যয় হয়েছিলো ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে কাশ্মীরি কুল, পেয়ারা, মাল্টা ও আমের বাগান করে গত বছর আয় হয়েছিলো ৮০ লাখ টাকারও বেশি।

দ্বিতীয় বছরে তিনি বাগানের পরিধি বাড়িয়ে আগের গাছগুলোর পাশাপাশি ড্রাগন, কমলা, শরিফা, লেবুসহ আরও কয়েক জাতের দেশি ও বিদেশি আমের গাছ লাগান। ২০২০-২১ সালে এ থেকে তার আয় হয় ৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। লাভের মুখ দেখে পরের বছর তিনি বাগানের পরিসর আরও বাড়িয়ে নেন।

এখন তার বাগানের আয়তন ১০৩ বিঘা প্রায় ৩৩ দশমিক ৯৯ একর। এর মধ্যে অনেকের নিকট থেকে জমি লিজ নিয়েও তিনি বাগান করেছেন। ফরিদপুরে কাশ্মীরি কুলের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ তিনিই প্রথম শুরু করেছেন। এরপর এই কুলের কলম করে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

মফিজুর রহমান মাফি জাগো নিউজকে জানান, প্রথম বছর তিনি ভারত থেকে কাশ্মীরি কুলের চারা সংগ্রহ করে ১ হাজার ৮৬০টি চারা দিয়ে তিনি এ বাগান তৈরি শুরু করেন। বাগানের পরিচর্যায় তিনি বিভিন্ন জৈব সার, সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করেন। তার মতে, কৃষিকাজের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি রয়েছে। এই কাজে পরিশ্রম করতে পারলে সুফল পাওয়া যায়।

ফরিদপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, মফিজুর রহমান মাফি একজন সফল যুবক। দেশে বেকারত্ব লাঘব ও যুবসমাজের কর্মসংস্থানে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে উদাহরণ তৈরি করেছেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতায় কৃষিক্ষেত্রে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তিনি।

এন কে বি নয়ন/এমএমএফ/জেআইএম