সাহিত্য

তবু আর দেখা হবে না

আজ মেইল খুলে চমকে গেলাম। আগে পেতাম কবিতা। আর আজ? আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। দু’সপ্তাহ আগেই তো পেলাম কতগুলো কবিতা, প্রেমের কবিতা শিরোনামে। তার থেকে ছেপেও দিলাম কয়েকটি। কিন্তু আজ? ‘কবি নাজমুল হক নজীরের স্মরণসভা অনুষ্ঠিত’ শিরোনামে একটি প্রেস রিলিজ। মেইলটা এসেছে নজীর ভাইয়েরই মেইল থেকে। মেইল খুলবার আগে আশা করেছিলাম কবিতা, পেলাম মৃত্যু নয়, একেবারে স্মরণসভার খবর। একটি মেইল থেকে আরেকটি মেইলের দূরত্ব একেবারে জীবন-মৃত্যু পর্যন্ত। নজীর ভাই লম্বা ছিপছিপে দীর্ঘকায় মানুষ। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটেন। মাথাভর্তি চুল। বসে যাওয়া গাল। হয়তো দাঁত কমে যাচ্ছে বলে।এই লেখা লিখতে বসে একটা কথাই বারবার বলতে ইচ্ছে করছে, নজীর ভাই আমাকে ভালোবাসতেন। তাঁকে পেলেই আমি তাঁর গা থেকে গ্রামের কাদামাটি শ্যাওলার ঘ্রাণ শুঁকতাম।তাঁকে প্রথম দেখি দৈনিক ডেসটিনি অফিসে। রাজীব রায়ের কাছে আসতেন বইয়ের প্রচ্ছদ করতে। রাজীব দা নিষ্ঠার সঙ্গে করেও দিতেন। নজীর ভাই একটি একটি প্রচ্ছদের ল্যাবপ্রিন্ট আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘দ্যাহো তো ক্যামন হৈছে?’ হাতে নিয়ে দেখলাম, বইটির নাম সম্ভবত, ‘হৃদয় অবাধ্য রঙিন’। রঙিনের সঙ্গে অবাধ্য শব্দের ব্যবহার দেখে তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ জাগলো। অন্তত এই কবি ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ নন। তারপর ডেসটিনি অফিসের নিচে, কনকর্ডে বা বইমেলায় যখনই দেখা হয়েছে খপ করে আমার হাতটি নিজের মুঠোয় চেপে ধরেছে। আর আমিও বন্দি হয়ে থেকেছি একটি দীর্ঘকায় বৃক্ষের বাকলে। মনে পড়ে কোনোদিনও তিনি আমাকে চা-নাস্তার বিল দিতে দিতেন না। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভূগেছিলেন। কেমো থেরাপি নিতেন। আমাদের বেনসন দিয়ে নিজেও জ্বালাতেন। আমরা গালমন্দ করতাম। নজীর ভাই বিড়ি খাওয়া ছাড়তে হবে। তিনি বলতেন, ‘বাসায় তো খাওয়া যায় না। তোমাগো পাইছি একদিন দুইদিন খাইলে কিছু হৈবো না।’ এজন্য তাকে পেলে আমি সিগারেট খেতে চাইতাম না। তাঁর সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিলো একদিন সন্ধ্যায় কনকর্ড মার্কেটে। তাও বছরখানেক হয়ে গেছে। আমাকে পেয়ে হঠাৎ তিনি অবাধ্য রঙিন হয়ে উঠলেন। চা-সিগারেট ছাড়া কথাই বললেন না। আমি তাকে পুনর্বার ক্যান্সারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, ‘বাদ দেও দি।’নজীর ভাইকে আমি একটি ধারাবাহিক লিখতে বলেছিলাম। তাঁর শৈশব-কৈশোর বিশেষত তাঁর কবি জীবন নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের কথা। কবি আহসান হাবীবের সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠতার কথা। তিনি তখন কবিতার বই প্রকাশের যন্ত্রণায় ভূগছেন। আমি বললাম, ‘নজির ভাই একটা নির্বাচিত করেন। আমি কবিতা বাইছা করে দিবো। প্রকাশনা উৎসব করবো একেবারে আপনাদের গ্রামের বাড়িতে, ধানক্ষেতে।’ উনি বহুদিন বলেছেন তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা। অনুষ্ঠান করার কথা। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি। হবেও না কোনো দিন।নজীর ভাই ‘নজীর বাংলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এটি দৈনিক না সাপ্তাহিক তা মনে পড়ছে না। তবে অনিয়মিত ছিলো। উনিই পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। যথারীতি সাহিত্য সম্পাদকও। সেখানে সম্ভবত তিনি আমার লেখাও ছেপেছেন। তাঁকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী-আলফাডাঙ্গার সাংবাদিকতার পথিকৃতও বলা হয়। আমাদের ওইসব পিছিয়ে পড়া অঞ্চল থেকে পত্রিকা প্রকাশ বা সাহিত্য চর্চা করা প্রায় অসম্ভব কাজ। নজীর ভাই তার নজির স্থাপন করেছেন। নজীর ভাই কোনোদিন চাকরি করেছেন বলে জানি না। পৈত্রিক বিপুল সম্পত্তি তাকে কেরানি হতে দেয়নি। সারা জীবন তা বেচাকেনা করেই খেয়েছেন। আর লগ্নি করে গেছেন মূলধন খোয়ানোর আশাতেই। আমি জানি না, হয়তো এই কবিচরিত্রটিকে তাঁর পরিবার কীভাবে দেখেছে। এরকম অবৈষয়িক মানুষ তো পৃথিবীতে বিরল হতে চলেছে। আমি বিশ্বাস করি, বোয়ালমারীর মানুষ তাঁকে মনে রাখবে চিরদিন। তার নামে কোনো স্থাপনা বা সড়কের নাম বা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করবে। সেইসব কাজে যদি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারি তাহলে আমার অনেক ভালো লাগবে। নজীর ভাই, আপনি আছেন চিরদিন, তবু আর দেখা হবে না, এটাই কষ্ট। কবি নাজমুল হক নজীরের একটি কবিতা পাঠকের জন্য তুলে দিলাম- সাক্ষাৎকার শেষ বারের মতো যখন তার কাছে যাই ভাঙা ভাঙা স্বপ্নে কেবলি বিবর্ণ মুখে,সে আমাকে শুধু ভুল নামে ডাকে আমি যেন ছায়া তার না মাড়াই।যেমন নদী ভুলে যায় ভাদ্রের কথা শ্রাবণ সন্ধ্যায় মুছে যায় কোলাহল, মেঘ তার তর্জন গর্জন কিম্বা জল যেমন ভূমিতে জমে থাকে কতো কথা। তবু বলি তারে শুনাই প্রিয় সংলাপ প্রিয়তমা ধান-দূর্বা তুলে দুই হাতে, বরণে বরণে খড়কুটো তুলে দাঁতেফেব্রুয়ারির মতো ফোটাও গোলাপ। এই লেখাটি শেষ করে নজির ভাইয়ের ছবি খুঁজতে গেলাম গুগলে। নিউজও দেখলাম। উনি মারা গেছেন ২৩ নভেম্বর, ঢাকায়। মানে প্রেমের কবিতা ছাপার আগেই।এসইউ/আরআইপি

Advertisement