জ্বালানির দর অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এ খাতটিতে। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী অর্ডার বাতিল করতে শুরু করেছে দেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ওয়ালমার্ট। এর ধাক্কা লেগেছে দেশেও। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কারখানাগুলোর জন্য এই চাপ সামলানো কঠিন হবে। তবে তারা আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
Advertisement
উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিশ্বের অনেক ক্রেতা পোশাক কেনা কমিয়েছেন। পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যেও নতুন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। চলমান অর্ডারও স্থগিত রাখা হচ্ছে। এরই মধ্যে ওয়ালমার্টের অর্ডার বাতিলের খবর পুরো পোশাক খাতের জন্য খারাপ সংবাদ।
বাড়তি খরচের শঙ্কা নিয়েও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক উৎপাদক
পোশাক মালিক ও রপ্তানিকারকরা আরও বলছেন, ওয়ালমার্টের পদক্ষেপ বাংলাদেশের পোশাক খাতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কারণ, ওয়ালমার্ট বাংলাদেশের প্রধান ক্রেতা। সরবরাহের জন্য প্রস্তুত কিছু অর্ডারের শিপমেন্ট বাতিল করেছে ওয়ালমার্ট। আবার প্রক্রিয়াধীন শিপমেন্টগুলোও স্থগিত করেছে। তাদের অর্ডার বাতিল মানে মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলারের হিসাব। সেক্ষেত্রে কারখানাগুলোর জন্য এই চাপ সামলানো কঠিন হবে।
Advertisement
আরও পড়ুন: অর্ডার বাতিল করছে ওয়ালমার্ট, বড় ক্ষতির মুখে পোশাকশিল্প
এ বিষয়ে তৈরিপোশাক মালিক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় কিছু শঙ্কা আমরা আগেই করেছিলাম যে সামনে একটা বাজে সময় আসতে পারে। সেটার ফলাফল পায়নি, তবে আভাস পাচ্ছিলাম। সেই ধারাবাহিকতায় ওয়ালমার্ট থেকে আসলো। আমাদের খরচ বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে অর্ডার বাতিল হলে পুরো সেক্টরের জন্য খারাপ হবে। ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের পরিচালক রুবেল আরও বলেন, ওয়ালমার্ট আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তাদের অর্ডার বাতিল হওয়া মানে এক দুই হাজার ডলার না। এটা মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলারের হিসাব। সেক্ষেত্রে এই চাপ সামলানো কারখানাগুলোর জন্য কঠিন হবে। কারণ, যারা তাদের কাজ করে তারা শুধু ওয়ালমার্টেরই কাজ করে। সুতরাং তাদের ক্যাপাসিটির যদি ১০ বা ২০ শতাংশ কমিয়ে দেয় সেটাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে এই খাতে। এটা ওয়ালমার্ট ছাড়া অন্যান্য ব্র্যান্ডের জন্য হলে এত প্রভাব পড়বে না।
‘ওয়ালমার্টের কাজ পাওয়া কারখানাগুলো অনেক বড় মাপের। সুতরাং তাদের এই ধাক্কা সামলিয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন হবে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত গ্যাপ পূরণ করা দুরূহ ব্যাপার। এটা পুরো পোশাক খাতের জন্য খারাপ সংবাদ। আপাতত অবজারভেশন করা ছাড়া কোনো কিছুর সুযোগ নেই। অবজারভেশন করে আমাদের দেখতে হবে।’
এদিকে, পোশাক কারখানাগুলোতে জেনারেটর থাকলেও তার তেমন ব্যবহার ছিল না। কেবল জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্যই জেনারেটর রাখা হতো। কিন্তু গত মাসে লোডশেডিং শুরু হওয়ার পর এখন প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত চলছে জেনারেটর। গড়ে প্রতিদিন ২০০ লিটার ডিজেল পোড়াতে হচ্ছে। এতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে মালিকদের। এর সঙ্গে জ্বালানির দর অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণে পোশাকের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। বাড়তি ব্যয় সামাল দেওয়ার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না শিল্পটি।
Advertisement
আবার উৎপাদন খরচ বাড়লেও উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে এমন পোশাকের দর নির্ধারণ করা হয়েছে অন্তত আরও দুই মাস আগে। তখনকার পরিস্থিতি অনুযায়ী চুক্তি হয়। এখন উৎপাদন পর্যায়ে এসে নতুন করে দর বাড়ানোর প্রস্তাবের সুযোগ নেই। ফলে লোকসান দিয়েই আগের অর্ডার সরবরাহ করতে হবে। এটিও খাতের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে।
আরও পড়ুন: গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ব্যাহত উৎপাদন, শিল্প মালিকদের কপালে ভাঁজ
এছাড়া তৈরিপোশাকের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের তথ্য বলছে, জুলাই মাস শেষে ওই অঞ্চলে মূল্যস্ম্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এটি গত ২৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আবার পোশাকের একক প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রেও মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ। এটি গত ৪১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূলত রেকর্ড মূল্যস্ম্ফীতির কারণে এসব দেশে পোশাকের চাহিদা কমেছে।
এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো, ইপিবির তথ্যমতে, জুলাই মাসে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৩৯৮ কোটি ডলারের পণ্য। এটি জুনে ছিল ৪৯১ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে ৯৩ কোটি ডলার। আবার প্রতিমাসে রপ্তানির টার্গেট ছিল সাড়ে ৫০০ কোটি ডলার।
কিছু স্টোর বন্ধ করেছে ওয়ালমার্ট
চলমান মন্দা এবং সংকট নিয়ে নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বর্তমানে সরকারের আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে রপ্তানি। অথচ পোশাকসহ অন্যান্য পণ্যে বায়ার থেকে নতুন অর্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি চলমান অর্ডারও স্থগিত রাখা হচ্ছে। আমরা কঠিন সময় পার করছি।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমস্যাসহ নানান ভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমছে। এ কারণে রপ্তানির পরিবর্তে আমদানি বাড়ছে। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। রপ্তানি আদেশ কমে যাচ্ছে, নতুন অর্ডার নেই। ম্যাটারিয়ালসের দাম বেড়েছে, উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ব্যবসা সহজের কথা বললেও, ব্যবসা আরও কঠিন হচ্ছে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে থমকে যায় অর্থনীতির গতি। ভেঙে পড়ার শঙ্কায় আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা। বিশ্বে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের সংকটে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকার মতো ক্রেতারাও পোশাক কেনা কমিয়েছেন। এতে অনেক অর্ডার বাতিল করে দিতে হচ্ছে ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠানকে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি যদিও অধিকাংশ গ্রীষ্মকালীন সংগ্রহই বিক্রি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ইনভেনটরি নতুন করে ঠিক করছে। তবে চলমান পরিস্থিতি ঠিক হতে দুই প্রান্তিক লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন ওয়ালমার্টে প্রধান নির্বাহী।
ইএআর/এমএইচআর/জিকেএস