চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট মজুতের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। ফলে তৈরি হচ্ছে চালের সংকট। তাদের ‘চালবাজিতে’ অস্থির হয়ে উঠছে খুচরা ব্যবসায়ীসহ সাধারণ ক্রেতারা। শুধু চাল নয়, তাদের গুদামে হাজার হাজার টন ধানও মজুতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও বগুড়ায় চালের মোকামে অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বগুড়ার শেরপুর উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুসের ১০টি গুদামে কয়েক হাজার বস্তা ধান ও চাল মজুত রয়েছে। একইভাবে ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম, হিটলার হোসেন, হাশেম আলী, আমিনুল ইসলাম মিন্টু, আলামিন হোসেন, গোলাম রব্বানী, প্রদীপ সাহা, কানাই শাহ, গৌর শাহ, জাকির হোসেন ও সঞ্জয় দেসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর গোডাউনে রয়েছে হাজার হাজার বস্তা ধান-চাল।
উপজেলার আলাল গ্রুপের অটো রাইস মিল, উত্তরবঙ্গ অটো রাইস মিল, শিনু অ্যাগ্রো ফুড লিমিটেডের অটো রাইস মিল ও মজুমদার অটো রাইস মিলেও কয়েক হাজার বস্তা ধান ও চালের মজুত রয়েছে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: নওগাঁয় কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে চালের দাম
Advertisement
অনুসন্ধানে জানা যায়, নওগাঁর ন্যাশনাল অটো রাইস মিল, বেলকন কোম্পানি, সরস্বতীপুরে এসিআই কোম্পানি, মহাদেবপুরে বিসমিল্লাহ অটো রাইস মিল, লস্করপুরে ঘোষ অটো রাইস মিল, কালীতলা সুলতানপুরের সুফিয়া অটো রাইস মিল, এম কে অটো রাইস মিল, বাইপাস মোড়ের তসিরুন অটো রাইস মিল, সরদার অটো রাইস মিল, আনন্দনগরের আর এম রাইস মিল, লস্করপুরের খগেন রাইস মিলে রয়েছে কয়েক হাজার মণ ধান-চাল।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার সাদিয়া রাইস মিল, পাঁচবিবি উপজেলার মণ্ডল চালকল, আক্কেলপুর উপজেলার মাহিন চালকল, কালাই পাঁচশিরা বাজারের থ্রি ফুডস প্রসেসিং মিলের গুদামেও রয়েছে হাজার মণ ধান-চাল।
দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় অন্তত দুই হাজার চালকল রয়েছে। এর মধ্যে অটো রাইস মিল ও হট ফ্লু মিল প্রায় ২০০টি। বাকিগুলো মেজর ও হাসকিং মিল। দিনাজপুর সদর, বীরগঞ্জ ও বোচাগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি চালকল রয়েছে। এখানকার বড় মিলগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই হাজার হাজার মণ ধান-চালের মজুতের খবর পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন: সহসাই কমছে না দাম: মোটা চালে বেড়েছে ২ টাকা
Advertisement
মজুত ও চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, সরকারি নিয়ম মতে মিল মালিকরা ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন ও চাল ১৫ দিনের বেশি মজুত করে রাখতে পারবেন না। যারা ধান-চাল মজুত করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আমাদের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ রয়েছে। ধান-চালের ঘাটতি থাকলে আমদানি করে সেটি পুষিয়ে নেওয়া হতো। কিন্তু লাইসেন্স দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা আমদানি করেননি। প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়ানো কোনোভাবে মেনে নেওয়া হবে না।
পরিবহন খরচের অজুহাতওই সিন্ডিকেট চালের দাম বাড়ার পেছনে পরিবহন খরচকে দায়ী করছে। তবে বিভিন্ন স্থানে দূরত্ব অনুসারে পরিবহন খরচের হিসাব মিলেছে নগণ্য। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর দিনাজপুর থেকে ২৫০ বস্তা (১৭ হাজার ৫০০ কেজি) চাল নিয়ে একটি ট্রাক ঢাকা গেলে ভাড়া গুনতে হয় ১৮-২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে প্রতি বস্তায় (৭০ কেজি) লেবার খরচ ও আড়তদারি মিলে আরও ১৪ টাকা যোগ হয়। খরচ যোগ করে কেজিপ্রতি চালে খরচ হয় ১ টাকা ২২ পয়সা থেকে ১ টাকা ৩৪ পয়সা।
আরও পড়ুন: আমদানির পরও হিলিতে বেড়েছে চালের দাম
দেশের সবচেয়ে বড় চালের মোকাম নওগাঁয়। সেখান থেকে ২৫০ বস্তা চাল রাজধানী ঢাকায় নিতে ট্রাকভাড়া লাগে ১৫-১৬ হাজার টাকা। যথারীতি বস্তাপ্রতি লেবার খরচ ও আড়তদারি বাবদ গুনতে হয় আরও ১৪ টাকা। হিসাব করলে প্রতি কেজি চাল নওগাঁ থেকে ঢাকায় আনতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ১ থেকে ১ টাকা ১০ পয়সা। অথচ ওই সিন্ডিকেট প্রতি কেজি মোটা চালসহ অন্যান্য চালের দাম ৫-১০ টাকা বাড়িয়েছে, যা মোট খরচের ১২ গুণেরও বেশি।
চালের বাজারদরদিনাজপুরের বাহাদুর বাজার এন এ মার্কেটে পাইকারি প্রতি বস্তা বিআর-২৮ বিক্রি হয় দুই হাজার ৯০০ থেকে দুই হাজার ৯৫০ টাকা। প্রতি বস্তা বিআর-২৯ বিক্রি হয় দুই হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৮৫০ টাকা, মিনিকেট প্রতি বস্তা তিন হাজার ৪০০ থেকে তিন হাজার ৪৫০, গুটিস্বর্ণা প্রতি বস্তা দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫৫০, বাসমতি প্রতি বস্তা তিন হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার ৯৫০, নাজিরশাইল তিন হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার ৯৫০ ও সুমন-স্বর্ণা প্রতি বস্তা দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৭৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি বিআর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকায়। একইভাবে বিআর-২৯ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬২ টাকা, মিনিকেট ৭০-৭২, গুটিস্বর্ণা ৫২-৫৩, বাসমতি ৮০-৮২, নাজিরশাইল ৮০-৮২ ও সুমন-স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৮-৬০ টাকায়।
বগুড়ার পাইকারি বাজারে প্রতি মণ জিরাশাইল বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ টাকা, কাটারি প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) তিন হাজার ৪০০ ও রণজিৎ প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) দুই হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
আরও পড়ুন: অস্থির চালের বাজার
নওগাঁর খুচরা বাজারে সম্পা-কাটারি প্রতি কেজি ৬৫-৭৩ টাকা, মিনিকেট (জিরাশাইল) ৬০-৬৬, বিআর-২৯ প্রতি কেজি ৫৮-৬২ ও গুটিস্বর্ণা প্রতি কেজি ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমির মওলা নামের এক খুচরা ক্রেতা বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিদিন চালের দাম বাড়ছে। মাস শেষে কীভাবে সংসারের হিসাব মেলাবো বুঝতে পারছি না।
বগুড়ার পাইকারি চাল ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক বলেন, মোকামগুলোতে চালের দাম বেশি। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর প্রতি বস্তা চালে দেড়শ থেকে আড়াইশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বিআর-২৮ চাল প্রতি বস্তা বেড়েছে সাড়ে ৩০০ টাকা। আমরা বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করছি। মজুতদাররা মোটা অংকের লাভ করছে।
আরও পড়ুন: এক লাফে কেজিতে ৪ টাকা বাড়লো চালের দাম
দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হুসাইন বলেন, ধানের দাম অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা ধান-চাল গুদামে মজুত করে রেখেছে এ অভিযোগ সঠিক নয়। ধানের দামের সঙ্গে পরিবহন ও লেবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়ছে বলে দাবি করেন তিনি।
নওগাঁর পুরান চালপট্টি এলাকার কিরণ ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মোহন সরকার বলেন, তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিলগেটে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চালের দাম ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মিনিকেট গেটেই তিন হাজার ৩০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এভাবে সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়েছেন মিল মালিকরা। মিল থেকে দোকানে আনা পর্যন্ত প্রতি কেজি চালে ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
জেলার চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, মিলারদের মধ্যে ধান কেনার প্রতিযোগিতা থাকায় দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। জ্বালানি ও ধানের দাম বাড়ার কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে, যা আগামী তিন মাসের মধ্যে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।
আরও পড়ুন: আমদানির সময়েও চালের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের উচিত সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী সময়ে চালের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। মোটা চালের দাম বাড়লে সমস্যায় পড়েন স্বল্প আয়ের মানুষ। এ বিষয়ে সরকারের কড়া নজরদারি দরকার।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাজারে চালের দাম অনেক বেশি। মূল্যবৃদ্ধি যদি ধান মজুতের কারণে হয় তবে সেটি বন্ধ করতে বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। কোনো অসঙ্গতি থাকলে অসাধু ব্যবসায়ীদের বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেন, কার কাছে কত ধান মজুত রয়েছে সেটি বের করতে হবে। কোথায় এবং কেন ধান মজুত রয়েছে সেটি সরকারকে দেখতে হবে। তাহলেই চালের দাম কেন বাড়ছে তার কারণ জানা যাবে।
আরএইচ/জেআইএম