সভ্যতার এই উৎকর্ষের যুগেও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লীতে ঢুকলে মনে হয় তারা যেন আদিম যুগেই রয়ে গেছেন। এই সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের মৌলিক চাহিদা পূরণের বন্দোবস্ত নেই বললেই চলে।
Advertisement
পাবনার ঈশ্বরদীর নৃগোষ্ঠীর বাসিন্দারা শিক্ষা-স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ প্রায় সব ধরনের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বসতবাড়িতে স্যানিটেশনের ব্যবস্থা না থাকায় এখনো অনেকেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে খোলা মাঠ ও জঙ্গলে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লীতে নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। দেড় থেকে দুই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শিশুদের পাশের গ্রামের বিদ্যালয়ে যেতে হয়। ফলে শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়ছে শিশুরা। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তাদের ন্যূনতম ধারণা নেই। বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সরকার প্রদত্ত অনুদান যা কিছু আসে তাও পুরোপুরি পৌঁছে না তাদের কাছে।
ঈশ্বরদীর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা এক সময় প্রচুর জমি-জমার মালিক থাকলেও ভূমি দস্যু ও কিছু অসৎ ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজসে দিনের পর দিন জমি হারিয়ে তারা ভূমিহীনে পরিণত হয়েছেন। এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ নৃগোষ্ঠীর সদস্য ভূমিহীন। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর ভারত থেকে ফিরে এসে দখল হয়ে যাওয়া জমি আর ফেরত পাননি তারা। বাড়িঘর মেরামত ও চাষাবাদ করতে গিয়ে কিছু জমি বন্দক রাখতে হয়। পরবর্তীকালে এসব জমি তারা আর ফিরে পাননি। ভূমিদস্যূরা কৌশলে তা দখল করে নিয়েছেন।
Advertisement
উপজেলার প্রত্যন্ত পল্লীতে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বসবাস করেন। এদের মধ্যে মালপাহাড়ি, বাগদি, মুন্ডা, ভূঁইমালি, লোহার বা কর্মকার উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও এ উপজেলায় রাজবংশী, বুনো, রবিদাস, ঋষিদাস ও বাদ্যকারের মতো সম্প্রদায়ের লোকজনও রয়েছে।
উপজেলার মারমী, লক্ষীকোলা, চকশ্রীরামপুর, মুলাডুলির কলকলি, নিকরহাটা ও নওদাপাড়া গুচ্ছগ্রামে মালপাহাড়ি সম্প্রদায়ের ১৭০টি পরিবারের প্রায় ৭৫০ জন বসবাস করেন। এদের মধ্যে ৩৭০ জন মারমীতে বসবাস করেন। মালপাহাড়িদের জীবনযাপন পদ্ধতি, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, ভাষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। একসময় এদের প্রধান পেশা ছিল পশু শিকার। সময়ের বিবর্তনে বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় এদের অধিকাংশ এখন কৃষিসহ অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
মুলাডুলি ইউনিয়নের পতিরাজপুর গ্রামে বাগদি সম্প্রদায়ের ৭৫ পরিবার, বেতবাড়িয়া গ্রামে ৩৫ পরিবার, ফরিদপুরে ২০ পরিবার এবং দাশুড়িয়া ইউনিয়নের খয়েরবাড়িতে ১৩ পরিবার বসবাস করে। এই চার গ্রামে প্রায় ৪৭৫ বাগদি বাস করেন। দারিদ্রতা ও কুসংস্কারের বেড়াজালে বন্দি এ সম্প্রদায়ের মানুষ অত্যন্ত অর্থকষ্টে জীবনযাপন করেন। এদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ ও কুঁচিয়া মাছ ধরা। কেউ কেউ তীর-ধনুক-জাল দিয়ে খরগোশ ও কচ্ছপ শিকার করে নিজেদের অন্ন জোগান। পতিরাজপুর ও বেতবাড়িয়া গ্রামের নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের শতকরা ৮০ জনের বাড়িতে স্যানিটেশন সুবিধা নেই। তারা পাশের ইক্ষু খেত ও খোলা মাঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যান।
মুলাডুলি ইউনিয়নের গোয়ালবাথান ও আটঘরিয়া গ্রামে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ৪০ পরিবারের ১৩০ জন বসবাস করেন। নিকরহাটা গ্রামের লোহার বা কর্মকার সম্প্রদায়ের ৩০ পরিবারের ১৩৫ জন বসবাস করেন। এ নৃগোষ্ঠীরা লোহা গলিয়ে বা পিটিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি ও সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করেন। লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় এদের অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে কৃষিসহ অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
Advertisement
গোয়ালবাথান ও আটঘরিয়া গ্রামে মুন্ডা সম্প্রদায়ের ৪০ পরিবার বসবাস করে। মুন্ডাদের প্রধান পেশা গাছ কাটা, নদীতে মাছ শিকার ও কৃষি কাজ। তবে এখানকার মুন্ডারা এখন কেবল কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত।
দাশুড়িয়া ইউনিয়নের দাশুড়িয়া গ্রাম ও মুনশিদপুর গ্রামে ১৫ পরিবারের ৭৫ জন ভূঁইমালি নৃগোষ্ঠীর বসাবস। তারা মূলত পানের ব্যবসা করেন। এদের পূর্বপুরুষরা পানের চাষ করতেন। পাশাপাশি কৃষি কাজ করতেন। এখানকার ভূঁইমালিরা অন্যের জমিতে কৃষি কাজ ও ক্ষুদ্র ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
মুলাডুলি ইউনিয়নের বহরপুরে আট পরিবার ও খয়েরবাড়িয়া গ্রামে ১২ পরিবার বুনো নৃগোষ্ঠী বসবাস করেন। এরা বাঁশ-কাঠের পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কাঠ-বাঁশের দাম বৃদ্ধি ও নিজেদের তৈরি পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
উপজেলার পৌর এলাকার স্কুলপাড়া, দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মুনশিদপুর, মুলাডুলির রামচন্দ্রপুর ও লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের কৈকুন্ডা গ্রামে রবিদাস সম্প্রদায়ের ৪০০ মানুষের বসবাস। মূলত এরা জুতা সেলাই ও কৃষি কাজ করেন। লক্ষীকুন্ডা গ্রামে ঋষিদাস জনগোষ্ঠীর ১৫ পরিবারের ৮২ জন বসবাস করেন। এরা পদ্মার চরাঞ্চলে কৃষি কাজ ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন।
পাকশী রেলস্টেশনের পাশে গুড়িপাড়া ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন সাঁড়া এলাকায় রাজবংশী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোক বাস করেন। এখানে ৯৫টি পরিবারে প্রায় ৫৫০ রাজবংশী বাস করেন। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাদদেশে উত্তর পাশে একেবারে বিচ্ছিন্ন একটি পাড়ায় বাস করেন রাজবংশীরা। সাঁড়ায় ২৯টি পরিবারে ১৫০ জন বসবাস করেন। ভোজপুরিয়া ভাষা ব্যতীত পূর্বপুরুষদের জীবন ও সংস্কৃতির কোনো কিছুই আর তারা ধরে রাখতে পারেননি। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের সময় ব্রিটিশ সরকার এদের পূর্বপুরুষদের ভারতের বিহার অঞ্চল থেকে এখানে এনেছিলেন।
ঈশ্বরদীর নৃগোষ্ঠীর মধ্যে মালপাহাড়িরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাতটি গ্রামে ৭৫০ জন বসবাস করেন। মালপাহাড়িদের সবচেয়ে বেশি বসবাস মারমী গ্রামে। এ গ্রামেই রয়েছে এদের ধর্মীয় উপাসনালয় লুর্দের রানী মারিয়া গির্জা। প্রতি রোববার উপজেলার সব মালপাহাড়ি নারী-পুরুষ এ গির্জায় উপাসনার জন্য আসেন। লুর্দের রানী মারিয়া গির্জা সংস্কারের অভাবে বৃষ্টি হলেই টিনের চালার ছিদ্র থেকে পানি পড়ে। মারমী গ্রামে খ্রিস্টান মিশন পরিচালিত একমাত্র স্কুলটিও এখন বন্ধ। পল্লির কিছু শিশু কষ্ট করে দূরের স্কুলে গেলেও অধিকাংশ শিশুই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ১৯৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্ট ফিলিপস শিশু শিক্ষাকেন্দ্রটির অবকাঠামো এখনো আছে। কিন্তু শিশুদের কলকাকলি বা কোনো প্রাণচাঞ্চল্য নেই। স্কুলটিতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। শুরুতে খ্রিস্টান মিশন এটি পরিচালনা করলেও পরে কারিতাস নামে একটি বেসরকারি সংস্থা এর দায়িত্ব নেয়। কিন্তু অর্থাভাবে তারাও ২০১৯ সালে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।
মারমী গ্রামের গির্জা কমিটির সাধারণ সম্পাদক বার্নাট দাস বলেন, আমাদের একমাত্র গির্জাটি অর্থাভাবে সংস্কার করতে পারছি না। একটি বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে গির্জা নির্মিত হয়েছিল। এটি সংস্কার করা না গেলে যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।
বাগদি সম্প্রদায়ের প্রধান ভবেশ চন্দ্র সরকার বলেন, আমাদের এখানে বাগদি সম্প্রদায়ের যারা বসবাস করেন তাদের ৭৫ শতাংশের মানুষের নিজস্ব বসতভিটা নেই। আত্মীয়ের জমিতে ঘর তুলে থাকছেন। এমনও আছে ছয় কাঠা জমিতে ছয় পরিবার ঘর তুলে বসবাস করছে। রান্নাঘর ও বাথরুম করার জায়গা থাকে না।
পেশা সম্পর্কে তিনি বলেন, কেউ আর আগের পেশায় নেই। যে যার মতো কাজকর্ম করে কোনো রকমে বেঁচে আছে।
মারমী গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বার্নাট বিশ্বাস জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে ঘন বন ও বড় বড় গাছ কেটে সেখানে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন। দীঘিতে মাছ শিকার ও জঙ্গলের কাঠ কেটে, পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। কিন্তু গত ২২ বছর ধরে এ দীঘিতে মাছের চাষ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
মারমী গ্রামের ব্লক প্রধান মন্টু বিশ্বাস বলেন, এ দিঘী থেকে আমাদের কোনো লভ্যাংশ দেওয়া হয় না। আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
উপজেলা নৃগোষ্ঠী কমিটির আহ্বায়ক শ্রী মদন কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, এ উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার নৃগোষ্ঠীর লোকজনের বসবাস। আমাদের অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। স্বল্প সংখ্যক আছেন যারা এখনো তাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ধরে রেখেছেন।
পাবনা জেলা নৃগোষ্ঠী কমিটির সভাপতি রামপ্রসাদ মাহাতো বলেন, নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় সবসময়ই অবহেলিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে বসবাস করেন। তাদের সরকারিভাবে যতটুকু সহযোগিতা করা হয় তা অত্যন্ত নগণ্য।
তিনি আরও বলেন, পেট ভরে তিন বেলা খাওয়া ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এখনো আমরা জয়ী হতে পারিনি। এখনো অনেকে অর্থাভাবে না খেয়ে থাকেন। এ লড়াই আর কত কাল চালিয়ে যেতে হবে জানি না। অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নামে ঈশ্বরদীতে ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৫টি সরকারি ঘর বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ঘর নির্মাণ শেষ হয়েছে। দুটির নির্মাণ কাজ চলছে। আর বাকি পাঁচটি ঘর বরাদ্দের প্রস্তুতি চলছে।
তিনি আরও বলেন, ঘর বরাদ্দ পেতে হলে নিজ নামে জমি থাকতে হবে। ঘর নির্মাণের আবেদন করেছেন অনেকেই কিন্তু নিজ নামে যাদের জমি নেই তাদের ঘর দেওয়া সম্ভব নয়।
ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পি এম ইমরুল কায়েস বলেন, উপজেলায় কয়েক হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের বসবাস রয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে নৃগোষ্ঠীর জন্য ২৫টি ঘর বরাদ্দ এসেছে। যাদের ন্যূনতম দুই শতক জমি আছে, তারাই বাড়ি পাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হতে পারবে। যাদের জমি নেই, তাদের বাড়ি করে দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া গুচ্ছগ্রামে বেশ কয়েকজন নৃগোষ্ঠীর সদস্যের নামে বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন তারা সেখানে বসবাস করছেন। প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা নিয়মানুযায়ী পাচ্ছেন। নৃগোষ্ঠীর নারীদের নকশীকাঁথা ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও বাইসাইকেল প্রদান এবং নারীদের সেলাই মেশিন উপহার দেওয়া হয়েছে।
এমআরআর/এমএস