আধুনিক বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) উজ্জ্বল এক নাম। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য বড় কবির মতো তিনিও ছোটদের জন্য অনেক ছড়া লিখেছেন। ছোট-বড় সব পাঠকের জন্য প্রচুর ছড়া লিখেছেন। তাঁর দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে নিয়ে বেশ কিছু ছড়া লিখেছেন। বড়দের জন্যও লিখেছেন। সমাজের বিভিন্ন অনিয়ম বা অসঙ্গতি নিয়েও ছড়া লিখেছেন। তাঁর ছড়া সাহিত্য খুব কম আলোচিত হয়। তবে বলা যায়, যাঁরা শুধু ছড়া লিখে খ্যাতি পেয়েছেন; তাদের অনেকের চেয়ে শামসুর রাহমানের ছড়ার সংখ্যা কম। আবার অনেকের ছড়ার মানের বিচারে তাঁর ছড়ার মান উন্নত। সুন্দর সুন্দর ছড়া লিখেছেন তিনি। সমাজের কাছেপিঠের উপাদান, রূপকথা, মিথ, ইতিহাস ইত্যাদি তাঁর ছড়া-কবিতার উপাদান হয়েছে।
Advertisement
শামসুর রাহমানের প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ১৪টি। ছড়াগ্রন্থের নামকরণেও নান্দনিকতা রয়েছে এবং ছড়াগ্রন্থের নাম থেকে মনে হয় গ্রামের গন্ধ বের হচ্ছে। কোনোটায় মনে হয় সামনে শিশুর মুখ ভেসে উঠছে। শিশুদের প্রিয় জিনিসগুলো নিয়ে তাঁর ছড়াগুলো দারুণ। ছড়াগ্রন্থগুলো হলো: ‘এলাটিং বেলাটিং’, ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো’, ‘গোলাপ ফোটে খুকির হাতে’, ‘রংধনুর সাঁকো’, ‘লাল ফুলকির ছড়া’, ‘আগুনের ফুলকি ছোটে’, ‘নয়নার জন্যে’, ‘ইচ্ছে হলো যাই ছুটে যাই’, ‘তারার দোলনায় দীপিতা’, ‘সবার চোখে স্বপ্ন’, ‘চাঁদ জেগেছে সবার চোখে’, ‘আমের কুঁড়ি জামের কুঁড়ি’, ‘হীরার পাখির গান’, ‘গোছানো বাগান’। ১৯৯৮ সালে কবির ৭০তম জন্মদিনে প্রকাশিত হয় ‘ছড়াসমগ্র’। বইটিতে কবির প্রথম ৬টি ছড়ার বইয়ের সবগুলো ছড়া তো আছেই; আরও আছে তখনো বইয়ের বাইরে থাকা আরও ৪০টি ছড়া। সেগুলো পরে তাঁর অন্য ছড়ার বইয়ে জায়গা পেয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থের অধিকাংশ ছড়ার মধ্যেই ফুটে উঠেছে শিশুর প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দরদ। তার ছড়ায় আছে ছোটদের মন ভোলানোর রূপকথার কাহিনি, আছে স্বপ্নরাজ্যের হাতছানি। সেইসঙ্গে আছে লৌকিক ছড়ার রূপ-রস ও সমাজমনস্কতা।
কবি প্রথমেই বলেছেন, তিনি কাদের জন্য ছড়া লেখেন। কবি তাঁর দুই নাতনি নয়না ও দীপিতাকে আনন্দ দেওয়ার জন্য অনেক ছড়া লিখেছেন। পরে এগুলো ক্লাসিক মর্যাদা পেয়ে গেছে। ‘এলাটিং বেলাটিং’ এ কবি লেখেন— ‘যারা বেড়ায় উড়ে পক্ষিরাজের পিঠে,যারা জিরোয় বসে স্বপ্নবাড়ির ভিটে,যারা ভেলকি বোঝে হঠাৎ মিলের ফাঁদের,ফাঁদের ফাঁদের ফাঁদের।আমার ছড়ার এ বই পড়তে দেবে তাদেরতাদের তাদের তাদের।’(এলাটিং বেলাটিং)
কবি তাঁর ছড়ায় কেবল ছন্দের দোলাই দেননি, কল্পনার ছবি এঁকেছেন। ছড়াগুলো অনেক সময় কিশোর-কবিতা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এলাটিং বেলাটিং’র প্রায় প্রতিটি ছড়ায় তিনি সচেতনভাবে গ্রামীণ জীবনের উপকরণ ব্যবহার করেছেন। একটি উদাহরণ— ‘নীলের ঘোড়া নীলের ঘোড়া পক্ষিরাজের ছা, মেঘডুমাডুম আকাশপারে তা থৈ তা থৈ তা।মেঘের দোলায় চললি কোথায়, কোন সে অচিন গাঁআয়-না নেমে গলির মোড়ে করবে না কেউ রা।’(আমায় নিয়ে যা: এলাটিং বেলাটিং)
Advertisement
জল-টুপটুপ, খোকন গেছে ক্ষীরসাগরে, জটিবুড়ির ছড়া, চরকাবুড়ি, আঁটুল-বাঁটুল ছড়া, খুকুমণির বিয়ে—এ ছড়াগুলোর নাম থেকেই বোঝা যায়, আমাদের রূপকথার চরিত্র ও কাহিনি নিয়েই তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন ছড়াগুলো। যেমন—‘আঁটুল বাঁটুল শামলা সাঁটুল শামলা গেছে হাটেকুঁচবরণ কন্যে যিনি, তিনি ঘুমান খাটে।খাট নিয়েছে বোয়াল মাছে, কন্যে বসে কাঁদে,ঘটি-বাটি সব নিয়েছে কিসে তবে রাঁধে?আর কেঁদো না আর কেঁদো না ছোলাভাজা খেয়ো,মাটির উপর মাদুর পেতে ঘুমের বাড়ি যেয়ো।’ (আঁটুল বাঁটুল ছড়া)
সুন্দর আরও একটি ছড়া হচ্ছে—‘মা মণিটার চোখ এড়িয়েগলির মোড়ের পুল পেরিয়েরোদের সাথে বুক মিলিয়েপাখনা-ভরা রঙ বিলিয়েএখান থেকে অনেক দূরেযদি আমি যেতাম উড়েপ্রজাপতির মতোকেমন মজা হত।’এটি ‘যদি আমি’ নামের ছড়া থেকে নেওয়া। যা ছড়াগন্থ ‘ধান ভানলে কুঁড়ো দেব’ থেকে নেওয়া। এ গ্রন্থে আছে আরও কিছু জনপ্রিয় ছড়া।
‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার কথা কে না জানে! এটি রীতিমতো প্রবাদের মতো হয়ে গেছে প্রায় প্রতিটি চরণ। চিলে কান নিয়েছে শুনে সবাই চিলের পিছে ছুটছে, অথচ কেউ খেয়ালও করছে না, কান আদৌ চুরি হয়েছে কি না! অসাধারণ ছড়াটি—‘এই নিয়েছে ঔ নিল যাকান নিয়েছে চিলে।চিলের পিছে ঘুরছি মরেআমরা সবাই মিলে।’(পণ্ডশ্রম: ধান ভানলে কুঁড়ো দেব)
ঝড়ের বিবরণের শেষে ঝড়-শেষের মানুষের অসহায়ের বিবরণ তুলে ধরেছেন একেবারেই সাদামাটা ভাষায়; কিন্তু সেই সাদামাটার ভাষার বর্ণনাই কী অসম্ভব শক্তিশালী! কী অসাধারণ!—‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁকশেয়ালের বে।সর্বনাশা ঝড়ের পরে কোমর বাঁধে কে?’(সাইক্লোন: ধান ভানলে কুঁড়ো দেব)
Advertisement
ছড়ার মাধ্যমে কবি সমসাময়িকতা তুলে ধরেছেন। সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। নানা অনিয়ম অপ্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেছেন। এরকমই একটি বিখ্যাত ছড়ার নাম ‘যা রাজাকার’। কবি বলেছেন— ‘যা রাজাকার ভেগে যা,এদেশ ছেড়ে ভেগে যাখোকার সাহস দেখে যা, মারের মজা চেখে যা।তোদের হাতে খুনের দাগভাগ রে তোরা জোরসে ভাগ।’(যা রাজাকার: রংধনুর সাঁকো)
লাল ফুলকির ছড়া বইয়ের কয়েকটি ছড়া আবার একেবারেই রাজনৈতিক। খেটে-খাওয়া অসহায় মানুষের কথা ভেবে লিখলেন, অসাধুদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় লিখলেন—‘সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভারনেইকো ঘরে জ্বালানি।পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট,ধন্য চোরাচালানি।’(ছড়া: লাল ফুলকির ছড়া)
রূপক ছড়া লিখলেন কবি শামসুর রাহমান। বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ ছড়াটিতে তিনি লিখলেন—‘ছেলে ঘুমায় না, পাড়ায় জুড়ায় নাবর্গিরা এল দেশে।বর্গি তাড়াবে তাই তো খোকনসাজল বীরের বেশে।’
‘রূপকথা’ নামের ছড়াটিও এক সময় খুব বিখ্যাত হয়েছিল। এটি একটি রূপক ছড়া। সোজা করে বললে, একটা জিনিসকে অন্য কোনো জিনিসের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করাই রূপক। তাঁর এই ‘রূপকথা’ নামের ছড়ার ‘আজব দেশের ধন্য রাজা’ বলে তিনি তখনকার স্বৈরাচারী শাসক এরশাদকে বুঝিয়েছিলেন। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের সময় ছড়াটি রীতিমতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। ছড়াটি এমন—‘আজব দেশের ধন্য রাজাদেশজোড়া তাঁর নামবসলে বলেন, ‘হাঁট রে তোরা’,চললে বলেন, থাম।’(রূপকথা: লাল ফুলকির ছড়া)
‘ট্রেন’ কিশোর কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে পড়ে শিশুরা খুব আনন্দ পায়। ট্রেন হচ্ছে ছোটদের প্রিয় একটি বস্তু বা বিষয়। আর শামসুর রাহমান কী চমৎকারভাবে লিখলেন। যা শিশুদের অন্তরে গেঁথে যায়—‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছেরাত দুপুরে অই।ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছেট্রেনের বাড়ি কই?....একটু জিরোয়, ফের ছুটে যায়মাঠ পেরুলেই বন।পুলের ওপর বাজনা বাজেঝন ঝনাঝন ঝন।’ (সংক্ষেপিত)
শামসুর রাহমানের ডাকনাম ছিল ‘বাচ্চু’। মা তাকে এ নামেই ডাকতেন। ‘মাগো তুমি’ কবিতায় মায়ের আবেগ ভরা সম্বোধনের স্মৃতি ফুটে উঠেছে এভাবে—‘এখন কে আর বলবে আমায়‘আয়রে বাচ্চু আমার কাছে?’দমকা হাওয়ায় পর্দা কাঁপেপাতা নড়ে একলা গাছে।’
শামসুর রাহমানের অনেক ছড়াই এখনো মানুষের মুখে মুখে। ছড়াগুলো টিকে থাকবে অনেক বছর। হয়তো যুগের পর যুগ। তারপরও আমরা তাকে ছড়াকার হিসেবে তুলে ধরি কম। তিনি কবি হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/এমএস