মতামত

জনজীবনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব ও করণীয়

পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে সম্প্রতি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী, টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল সদর , ঘাটাইল, মধুপুর, ও দেলদুয়ার উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে যাই। উপজেলাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে জাতীয় পর্যায়ের দুটি বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির কয়েকটি সমিতির অনেক সদস্যের সাথে আলোচনা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সাম্প্রতিককালে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিও ওঠে আসে।

Advertisement

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের সকলেই নারী সদস্য এবং প্রত্যেকেই বিবাহিত। তাদের অনেকেরই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে রয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই অল্প কিছু চাষাবাদের জমি আছে, কেউ কেউ গরু, ছাগল পালন করেন। আবার অনেকেরই স্বামী বা ছেলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত। অনেকেই ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালান। অনেকেই রিকশা বা ভ্যান চালান। আবার কেউ কেউ স্রেফ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রমিকের কাজ করেন। তাদের গড় মাসিক আয় ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ হাজার টাকার মধ্যে।

আকলিমা বেগম এর বয়স আনুমানিক ৪০ বছর (জাতীয় পরিচয় পত্র থাকা সত্ত্বেও এখনও গ্রামের অনেক মহিলা তাদের প্রকৃত বয়স বলতে পারে না) । সে একটি সমিতির সদস্য। এই সমিতিতে সে প্রতি সপ্তাহে ৫০ টাকা করে সঞ্চয় করত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। তার স্বামী একজন দিন মজুর। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে সে গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থদের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে। এতে তার মাসে প্রায় ১২,০০০ হাজার টাকা আয় হয়। আকলিমা বেগমের এক ছেলে ও এক মেয়ে । ছেলে গ্রামের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র আর মেয়ে ৫ম শ্রেণিতে লেখা পড়া করে।

এ বছর আকলিমা বেগম সমিতি থেকে ২০,০০০ টাকা লোন গ্রহণ করেছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় লোনের টাকা সে কি কাজে ব্যবহার করেছে। সে জানাই সংসারের খরচ মেটানোর জন্য সে এই ঋণ নিয়েছে। কারণ আগে যে টাকা তার স্বামী আয় করত তা দিয়ে কোন প্রকারে তার সংসার চলে যেত। কিন্তু গত কয়েক মাস যাবত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে তার পক্ষে সংসার চালানো ও ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখানো অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

Advertisement

সে আরো জানাই আগে তারা তিন বেলায় পেট ভরে খেতে পারত কিন্তু চালের দাম বেড়ে যাওয়াতে ভাত খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আগে সপ্তাহে দুই দিন সে তার ছেলে মেয়েকে মাছ ও ডিম খাওয়াতে পারত কিন্তু এখন সে তাও খাওয়াতে পারে না। শাক-সবজি ও সপ্তাহে একদিন মাছ দিয়ে তারা ভাত খেয়ে থাকে। এভাবে অনেক কিছুতেই সংসারের খরচ কমাতে হয়েছে তাকে। আকলিমার মতো আরো অনেকেরই অবস্থা একই রকম।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান করোনা মহামারি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, ইত্যাদি কারণে সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ও সাধারণ মানুষের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন।

তারা বলছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে, নির্দ্দিষ্ট আয়ের পরিবারগুলি মাংস, মাছ এবং ডিম খাওয়া কমিয়ে দিচ্ছে এবং আয়ের সাথে ব্যয়ের সংগতি রক্ষায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে কম খরচ করার পরিকল্পনা করছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম আগে থেকেই বেশি ছিল এবং জ্বালানি তেলের দামের সর্বশেষ রেকর্ড বৃদ্ধি সেটিকে আরও উপরে ঠেলে দিয়েছে এবং নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে খাদ্যের যোগান ঠিক রাখতে রীতিমত হিমসিম খেতে হচ্ছে। নিন্ম আয়ের লোকদের জন্য প্রোটিনের প্রধান উৎস ডিম যার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ।

পরিসংখ্যান দেখায় যে গত বছর (২০২১) নভেম্বর থেকে জ্বালানির দাম কয়েক দফায় ৭৫ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ডলারের ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত আট মাসে কমপক্ষে ৪০ ভাগ বেড়েছে। প্রধান প্রধান খাদ্যদ্রব্য যেমন চাল, ডাল, আটা, তেল, মাছ, মাংস, শাক, সবজী , কাঁচা মরিচ ছাড়াও গৃহস্থালীর বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে। যদিও নিন্ম ও নির্দ্দিষ্ট আয়ের আয়ের লোকেরা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক শিকার, মধ্যম আয়ের লোকেরাও এর প্রভাব তীব্রভাবেই অনুভব করছে।

Advertisement

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আয়ের সাথে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেড়ে যায়, তখন স্বল্প ও সীমিত আয়ের লোকেরা প্রথমে শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ কমিয়ে দেয়। তারা মাংস, মাছ, ফল এবং দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা বন্ধ করে এবং চাল ও আলু সহ শর্করা জাতীয় খাবারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশে একটি অপুষ্টিজনিত প্রজন্ম তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১ কোটি ৭০ লাখ বিবাহিত নারী অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে অপর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে তীব্রতম অপুষ্টিতে (সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশন বা এসএএম) ভুগছে দেশের অনেক শিশু। বিশেষ করে গত এক বছরে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির এ তীব্রতম মাত্রার প্রকোপ বেড়েছে অনেক বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে এতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যাও।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ৭২ শতাংশেরও বেশি। সুতরাং সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নারী ও শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা যে আরো বাড়িয়ে দিবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা যে কম হয় তা আমরা সবাই জানি।

একথা সত্য যে করোনা মহামারি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। এছাড়াও আমদানি ও রফতানির ভারসাম্য নষ্ট হওয়া ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসায় বৈদেশিক মুদ্রার বিশেষ করে ডলার রির্জাভের ওপর চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে জ্বালানীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে করে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের লোডশেডিং দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে খাদ্য , শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি সেক্টরে এর প্রভাব পড়েছে। এই সুযোগে অনেক অসৎ ব্যবসায়ী নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে জনজীবনকে দূর্বিষহ করে তুলছে। জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। সুতরাং এ বিষয়ে সরকারকে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বল্প ও নির্দ্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই ক্রমবর্ধমান চাপ যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব রোধ করা প্রয়োজন। বেসরকারি সংস্থা এবং ব্যাংকগুলোকে গ্রাম পর্যায়ে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। যাতে করে সাধারণ মানুষ তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে।

সর্বোপরি, অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।

সরকারকে প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। বর্তমানে আইন অনুযায়ী দোকানে দোকানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানো বাধ্যতামূলক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে থাকে। এছাড়া দেশের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আয়ত্বে আসবে।

তবে শুধু সরকার নয়, সাধারণ মানুষকেও দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধের জন্য সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। গণমাধ্যমগুলোকে অসৎ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এভাবে সরকার, বিরোধীদল, গণমাধ্যম, জনগণ ও ব্যবসায়ী সমাজের সম্মিলিত সহযোগিতায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটাই আজ দেশের সাধারণ মানুষের একান্ত কাম্য।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/এএসএম