দেশজুড়ে

সাড়ে ৬ টাকা জ্বালানি খরচে ইলিশের দাম বেড়েছে ১৫০-২০০!

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বরিশালে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে ইলিশের দাম বেড়েছে। প্রায় দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি পর্যায়ে ছোট ও মাঝারি সাইজের প্রতি মণ ইলিশের দাম ৫-৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সে হিসাবে কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা।

Advertisement

জেলে ও আড়তদারদের দাবি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ট্রলারে করে মাছ শিকারে আগের চেয়ে খরচ বেড়েছে। এজন্য ইলিশের দামও বেড়েছে।

কিন্তু ট্রলারে করে নদীতে মাছ শিকারের খরচ হিসাব করে দেখা যায়, ছোট একটি ট্রলারে আগে প্রতি কেজি ইলিশ শিকারে জ্বালানি খরচ হতো ১৬ টাকার মতো। এখন সেখানে খরচ হচ্ছে ২২ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কেজি ইলিশ শিকারে ৬ টাকা ৫০ পয়সা খরচ বেড়েছে। অথচ জ্বালানি তেলের বৃদ্ধির অজুহাতে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ইলিশের দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা।

চড়া দামের কারণে স্বল্প আয়ের ক্রেতারা ইলিশ কিনতে পারছেন না। একই কারণে ইলিশের ধারেকাছেও ভিড়তে পারছেন না মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বড় ইলিশের মোকাম বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা। আর গতবছরের তুলনায় প্রায় ৫০০ টাকা বেড়ে কেজি সাইজের ইলিশ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৫০ টাকা।

সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইলিশের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন। ডিমের দামের মতো এখানেও কারসাজি রয়েছে। তাছাড়া ইলিশ ভারতে পাচারও হচ্ছে। তাই ইলিশের দাম নাগালের বাইরে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের কাছে এত দাম দিয়ে ইলিশ কেনা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়।

পোর্টরোড মোকামের মেসার্স আব্দুল্লাহ মৎস্য আড়তের স্বত্বাধিকারী ও জেলা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য জহির সিকদার বলেন, অন্যবারের মতো এ বছর সাগরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নদ-নদীতও কম ধরা পড়ছে। আজ বিকেল পর্যন্ত পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ১০০-১৫০ মণ ইলিশ এসেছে। অথচ গতবছর মৌসুমের এ সময় হাজার মণের মতো ইলিশ আমদানি হয়েছিল। তখন ইলিশের দামও কম ছিল।

তিনি জানান, গতবছর এ সময় কেজি সাইজের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম ছিল ৮৫০ টাকা। আর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে কেজি সাইজের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছিল ৫৫ হাজার টাকায়। আজ তা বিক্রি হয়েছে ৬০ হাজার টাকায়। মণপ্রতি বেড়েছে ৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে কেজিতে ১২৫ টাকা বেড়েছে।

Advertisement

জহির সিকদার বলেন, চাহিদার তুলনায় ইলিশ সরবরাহ অপ্রতুল। এর বড় একটি কারণ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। জেলেরা ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের ট্রলার করে নদ-নদী ও সাগরে মাছ শিকার করেন। এখন বৈঠা দিয়ে নৌকা বেয়ে মাছ শিকারি জেলের সংখ্যা অনেক কম। ট্রলারগুলো ইঞ্জিনচালিত। ইঞ্জিন চালাতে প্রয়োজন তেলের। সেই জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়েছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাগরে মাছ শিকারে যেতে অনীহা তৈরি হয়েছে। কারণ সাগরে তেমন একটা ইলিশ ধরা পড়ছে না।

‘সাগরে মাছ ধরার বড় ট্রলারে প্রচুর জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এক জায়গায় মাছ না পেলে ট্রলার নিয়ে আরেক জায়গায় জেলেদের ছুটতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে ৪-৫ দিনে ৫০-১০০ মণের বেশি মাছ পাওয়া যায়। আবার কোনো কোনো ট্রলার ১০-১২ দিন সাগরে অবস্থান করেও ১০ মণ ইলিশও পায় না। তাদের লোকসান গুনতে হয়। এখন সেই লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়েছে’, যোগ করেন জহির সিকদার।

জেলা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ও আড়তদার ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আজ সারাদিনে মোকামে ইলিশের আমদানি হয়েছে অনেক কম। বিগত বছর এইসময় পোর্টরোড মোকামে ইলিশের আমদানি ছিল ৯০০-১০০০ মণ। এ বছর অর্থাৎ আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত সেখানে আমদানি হয়েছে ১৩০-১৪০ মণের মতো।’

আড়তদার ইয়ার হোসেন বলেন, নদ-নদীতে মাছ শিকারে মাঝারি ও ছোট আকারের ট্রলার ব্যবহার করেন জেলেরা। পোর্টরোড মোকাম থেকে দু-এক ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে জেলেরা তাদের পছন্দমতো নদ-নদীর পয়েন্টে জাল ফেলেন। সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত তারা মাছ ধরেন। এতে সাগরের মতো ৭-১২ দিন অবস্থান করার প্রয়োজন হয় না। জ্বালানি খরচ কম হয়।

তিনি বলেন, মাঝারি ধরনের একটি ট্রলারে প্রায় ৪৫-৫৫ লিটার ডিজেল খরচ হয়। তাতে জ্বালানি বাবদ প্রায় ছয় হাজার টাকার ব্যয় হচ্ছে। তবে দুই সপ্তাহ আগেও জ্বালানি বাবদ ব্যয় হয়েছে চার হাজার টাকা। অন্যদিকে ছোট ট্রলারে দুই সপ্তাহ আগে জ্বালানির ব্যয় ছিল হাজার তিনেক টাকা। এখন খরচ হচ্ছে সাড়ে চার হাজারের মতো। কিন্ত সাগরে তেমন একটা ইলিশ ধরা পড়ছে না।

ইয়ার হোসেনের ভাষ্য, সমুদ্রগামী ট্রলারে ৫-১০ মণ মাছ ধরলে লাভ করার সুযোগ নেই। সাগরে মাছ ধরার একটি ট্রলারে কম হলেও ১০ ব্যারেল অর্থাৎ দুই হাজার লিটার ডিজেল খরচ হয়। সপ্তাহদুয়েক আগেও ১০ ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল এক লাখ ৬০ হাজার টাকা। এখন একই পরিমাণ তেল কিনতে হচ্ছে দুই লাখ ২৮ হাজার টাকায়। অর্থাৎ তেলেই ব্যয় বেড়েছে ৬৮ হাজার টাকা। তাছাড়া আনুষঙ্গিক নানা খরচ আছে। যেমন বরফ, খাবার খরচসহ আরও কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়। তাই তেলের দাম বাড়ার পর অনেক জেলেই সাগরে যেতে চাচ্ছেন না।

দক্ষিণাঞ্চলের আরেকটি অন্যতম ইলিশের মোকাম পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলিপুর-মহিপুর বেসরকারী মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। সেখানেও ইলিশের খরা চলছে।

সেখানকার আড়তদার শাহ আলম জানান, উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ১০০ আড়ত আছে। লাভের আশায় মৎস্য খাতে লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেছেন এখানকার শত শত আড়তদার-মহাজন। পাশাপাশি মৎস্যজীবী ও বন্দরের কয়েক হাজার শ্রমিকের পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আড়তদার, মহাজন মৎস্যজীবী ও শ্রমিকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাছাড়া সাগরে তেমন একটা ইলিশ মিলছে না। ধারদেনা করে সাগরে গিয়ে লোকসানের মুখোমুখি হতে চাচ্ছেন না মৎস্যজীবীরা।

মহিপুর সংলগ্ন নজিবপুর এলাকার বাসিন্দা নুর ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, একদিকে তেলের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে ইলিশের আকাল। এখানকার মৎস্যজীবীদের খারাপ অবস্থা চলছে।

বৃহস্পতিবার সকালে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ইলিশ কিনতে আসা নাসির ফকির জাগো নিউজকে বলেন, “তেলের দাম বেড়েছে স্বীকার করছি। কিন্তু সেই অজুহাতে প্রতি কেজি ইলিশে দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ৭০০-৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশের। আড়তদাররা এ সাইজের ইলিশকে বলেন ‘এলসি সাইজ’। দুই সপ্তাহ আগেও ওই ইলিশের কেজি ছিল ১০০০-১১০০ টাকার মধ্যে। এখন বেড়ে ১২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের কেজি ছিল ৭৫০ টাকার মধ্যে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯০০ টাকা। আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছেন।’

ক্রেতাদের এমন অভিযোগের বিষয়ে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদার জহির সিকদার ও ইয়ার হোসেন বলেন, ‘ক্যালকুলেটর দিয়ে সব কিছু হিসাব করলে চলে না। শুধু ট্রলারের জ্বালানির হিসাব বের করলেই চলবে না। খাওয়া-দাওয়াসহ নানা খরচ আছে। সিন্ডিকেট বলতে এখানে কিছু নেই। এখানে মধ্যসত্ত্বভোগী নেই। ক্রেতারা সবসময়ই দাম চড়া বলেছেন।’

মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক পর অমাবস্যার জো। আশা করছি এরপর থেকে নদ-নদী ও সাগরে আশানুরূপ ইলিশ ধরা পড়বে। তখন দামও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।’

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে পুঁজি করে আড়তদারা অতিরিক্ত মুনাফা করছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে হয়তো ডিমের মতো কারণ থাকতেও পারে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারকি করলে আসল কারণ বেরিয়ে আসতে পারে।

এসআর/এএসএম