সাহিত্য

আষাঢ়, তুই এবং মৃত্যু: নারী প্রেমের কাব্যময় রূপ

বঙ্গ রাখাল

Advertisement

ছেলেটি দুরন্ত প্রকৃতির—দেখেও বোঝার জো নাই ছেলেটির মধ্যে এত এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। এত ভালো কবিতা লেখেন। আড্ডায় হাসতে হাসতে ছড়িয়ে দেন কল্পনা রেখার মূহ্য রূপ। যা আমাদের আবার ভাসায় চিন্তার জগতে। ঘোর সৃষ্টি করতেই বোধ হয় ছেলেটি বেশি পছন্দ করেন। ছেলেটির সঙ্গে অনেকবার আড্ডা দিয়েছি। গল্প, দুষ্টুমি, ঘোরাঘুরি অনেক কিছুই হয়েছে। আবার মাঝে মাঝে ধোঁয়া ভাসিয়েছি আকাশ পানে। হাঁটতে হাঁটতে এসেছি সুদীর্ঘ পথ। তবু আমাদের হাঁটা শেষ হওয়ার নয়।

যার কথা বলছি; তার নাম সাজেদুর আবেদীন শান্ত। অনেক ভালো ফিচার লেখেন। নিজের ভালো লাগা থেকেই তুলে ফেলেন ভালো লাগা অথচ হৃদয় কাড়ুনি ছবি। তবে নারীই বোধ হয় তার ছবির বড় অংশের মডেল। একটু ঠাট্টার মতো শোনালেও কথা সত্য। শান্ত মূলত কবি। তার চলনে-বলনে কিংবা সাজ-সজ্জায় একজন কবি। গুনগুন করে কবিতা বলেন, বলে যান হাজার খানেক প্রেমিকার নাম। এই কবি নারী বন্দনায় বেশ মশগুল। তা ফুটে ওঠে তার ‘আষাঢ়, তুই এবং মৃত্যু’ নামক পুস্তিকায়।

কবি নারী বন্দনা করবেন না কেন? তিনি তো প্রেমিক কবি। প্রেম তো শাশ্বত। স্বর্গ থেকে আসে প্রেম স্বর্গে যায় চলে যায়—‘নীল রঙের শাড়িতে তাকে প্রথম দেখেছি,তার ছোট্ট বোনের জন্মদিনে।শাড়িতে তাকে নীলাম্বরীর মত লাগছে,মেয়েদের কপালে নীল টিপ যে এতো সুন্দর লাগেতাকে দেখার আগে তা জানা ছিলো না।মনে হয় নীলে নীলে ছেয়ে গেছে পুরো পৃথিবী...’(নীলাম্বরী)

Advertisement

২. ‘এই সবুজের মাঠে, রঙ মাখতে চাই প্রজাপতির পাখায়আমি গন্ধ নিতে চাই ক্যাামেলিয়া, বকুল, গোলাপে...যতদিন বাঁচলে আমাকে অমর বলবেততদিন আমি পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ নিতে চাই।’(স্বস্তি চাই না)

কবি তো অনেক কিছুই বলে থাকেন কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন—যা বলেছি আসলে তা সত্যি না। তখন তিনি উচ্চস্বরে বলতে পারেন—কসম সে মেয়ে আমার না, সে আমার ঘোর। ...এই কবি সত্যিকার অর্থেই প্রেমিক সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেমিক বলতে আমরা শুধু নর-নারীর প্রেমকেই বুঝি। কবি কিন্তু নর-নারীর বাইরেও সন্তান-মায়ের যে প্রেম; সেই গভীর প্রেমের কথাও তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মা ছাড়া প্রকৃত ভালোবাসা কেইবা বাসতে পারেন। তিনি নিজের জীবন দিয়েই সন্তানের কল্যাণ চান। বাঁচাতে চান সন্তানের প্রাণ—‘আমি মরে যাচ্ছি, কারো যায় আসছে নাহঠাৎ পাশে ফিরে দেখি আমার মা কাঁদছে...আমি মরে যাচ্ছি, কেবল আমার মা টের পাচ্ছে।’ (মা)

আমরা কখন কীভাবে জীবনযাপন করি, সেটা অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই জীবন-অতিবাহিত হয়ে থাকে। কেউ আমরা সঠিক করে বলতে পারি না, কখন কার জীবনে কী ঘটে। এই অনিশ্চয়তার জীবন নিয়েই আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়। কিছু দিন আগেও আমাদের জীবন এক ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। হারাতে হয়েছে অনেক আত্মীয়-স্বজন কিংবা কলিজার টুকরাদের। তবুও আমাদের জীবন থেমে যাবার নয়। এই জীবনেরই সূত্র দিয়ে গেছেন কবি—...পৃথিবীর এই অসুখময় সময়ে? এই অসুখময় সময়ে সত্যিই আমরা অসুখী। সুখ যে এই সময় অচেনা—দূর দেখের পাখি।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষা ছিল প্রিয় ঋতু। এই বর্ষার সজীবতা কথাই তো তিনি বলছেন—কাটিকে কাটিতে ধান এলো বর্ষা। এই বর্ষা তার কবিতায় কতভাবে যে এসেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর আজকের কবি শান্তরও বর্ষা, প্রেমিকা ও মৃত্যু খুব প্রিয়। তিনি মরণের ভয় করেন না। তিনি নির্বিঘ্নে বলতে পারেন—আমি বর্ষাকাল ভালোবাসি। এই শৈল্পিক অভিব্যক্তিই কবিকে কবিতার মাধ্যমে মহান করে তুলেছে। কবি নিজের জীবনকে ভালোবাসেন না বলেই বলতে পারেন—‘একদিন মৃত্যুকে সাথে নিয়ে ছেড়ে যাবো তোকেকারণ আষাঢ়, তুই এবং মৃত্যু ভীষণ প্রিয় আমার।’ (আষাঢ়, তুই এবং মৃত্যু)

Advertisement

কবি শান্ত প্রেমিক হলেও অন্ধ কিংবা বোকা প্রেমিক নন। তিনি নিজের জীবনকেও বাজি রাখতে পারেন—প্রকৃত প্রেমিকার জন্য তার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে নিতে পারেন পৃথিবীর সবটুকু সুখ। কিন্তু এই ভালোবাসার মধ্যে কৃপণতা থাকলে কবি অনায়াসে বলতে পারেন—‘...তুই কি দাম্ভিক, অহংকারী? স্বার্থপর? অনেকটা আমার ঈশ্বরের মতো?’ (ঈশ্বরী থাকে মোহাম্মদপুরে)

প্রেমিকার জন্য মন পোড়াই—অন্তরে ধিকিধিকি ব্যথা করে। তার শূন্যতা কবিকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। এই না থাকা বা দূরে হারিয়ে যাওয়ার ব্যথায় কবি ব্যথিত প্রাণ। তবে তিনি এই শূন্যতায় আত্মহত্যা করতেও দ্বিধা করেন না। কবির জীবন একাকিত্বের জীব। এই জীবন তো আত্মহত্যা করার মতোই। কবি সেই জীবনকেই বেছে নিতে চান। তিনি জানেন, সব ভালোবাসাই বিকশিত হয় না বা সব ভালোবাসা প্রকাশও করা যায় না। সেই ভালোবাসা সবার অজান্তেই ব্যথা দিয়ে অন্তরে মরে যায়—ঝরে যায় ভোরের শিশিরের মতো... কিছু কিছু ভালোবাসা অন্তরেই কবর হয়। তবু প্রেম অন্তরে বেঁচে থাকে। এটা তো অন্তর দিয়ে অনুধাবন করতে হয়। ভুলতে চাইলেই কী তারে ভুলে থাকা যায়—ক. ‘তোমার শূন্যতা, বুকের ক্ষত বাড়ায়তুমি নেই,নেই কোথাও!...নিঃসঙ্গতাকে সতীন করে,আমি আবার চলতে থাকি পথ।...একজন কবির মতো আত্মহত্যা করি।’(আত্মহত্যা)

খ. ‘...তোমার কপালের দিগন্তে ছোট টিপযেন আমার হৃদপিণ্ডের ক্ষত’ (হিরন্মবালা-)

কবি ‘বসন্ত কুমারী’ কবিতায় আমাদের ছয় ঋতুকে দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। যা সত্যিকার কবির পক্ষেই এভাবে বলা সম্ভব। এই ‘বসন্ত কুমারী’ কবিতায় কবি তার সহজাত ভাবনাগুলোকে চিত্রকল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কবিতায় চিত্রকল্প রচনায় কোন দুর্বোধ্যতা নেই—অতি সহজ-সরল সাববলীল ভাষায় কবিতাকে কবিতা করারই চেষ্টা করেছেন। কবি তার জীবন অভিজ্ঞতাকেও কাজে লাগিয়েছেন। যা তার কবিতাকে নিখাদ ও সরল ভাষা গঠনে সাহায্য করেছে।

কবিকে শুধু প্রেমিক বললে হয়তো ভুলই বলা হবে। কেননা তিনি চিন্তা করতেও জানেন এবং পাঠককে চিন্তা করাতেও পারেন। একটি কবিতা তখনই স্বার্থক কবিতা হয়ে ওঠে; যখন কবিতার এক-দুইটি লাইন একজন পাঠককে ভাবতে বসায়। এ ভাবনাবোধই হয়তো কবিকে মহৎ করে তোলে। তেমনই কবিও যখন বলতে পারেন—...নষ্ট মগজ গলে পরতে থাকে চেতনা- ...এই কথা কি সহজ কোন কথা—না। এই লাইনই আমাদের নিউরনের অনুরণন ঘটায়। আমাদের ভাবনাকে শাণিত করে। মাঝে মাঝে তার কবিতা আমাদের ইন্দ্রজালিক কোনো আলো-ছায়া ছাড়ায়। আমাদের গতিকে আরও বেগবান করে তোলে। তাই কবিকে প্রেমিক কবি বললেও তার অন্তরালে সমাজ-বাস্তবতা কিংবা মৃত্যুর অদ্ভুত সত্য ভেতর থেকে নির্গত করতে পারেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মাঝে মাঝে কবিকে অজানা-অচেনা পৃথিবীর এক নিঃসঙ্গ সারস মনে হয়। কেননা তিনিও তো কবির প্রতিচ্ছবি—মৃত্যুর সহজাত। এ কবি প্রেমিক বটে। কিন্তু এত প্রেম কবি কাকে দেবেন বা কোথায় বিলাবেন। এজন্যই শঙ্খ ঘোষের মতো বলতে হয়—‘আমি আজ সুখী/সবার জীবন দিয়েছি নরক করে।’ প্রকৃতপ্রেম কাঁদায়ও বটে। সবার কাছে প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠলে কেউ মনের মানুষকে না পেলে বেদনা বাড়ে। তার কাছে সে জীবন নরক। আসলে এ প্রেমিক নরক করতে আসেননি। ভালোবেসেই সেই নরককে স্বর্গে রূপান্তিত করবেন। কবির প্রতি সেই প্রত্যাশা।

কবির কবিতা পাঠে পাঠক সংক্রমিত হন। কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। এটাই কবির জন্য বড় পাওয়া। কবি শান্তর চলার পথের কোনো সুনির্দিষ্টতা নেই। নেই সীমানা। তিনি ভাসাতে পারেন ইচ্ছের সাম্পান। এ ইচ্ছের সাম্পানই একদিন কবিকে নিয়ে যাবে নির্দিষ্টতার পথে। দেখাবে দ্যুতি। তবে এ নির্দিষ্টহীনতাই কবিকে কবি করে তুলতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।

লেখক: কবি ও গবেষক।

এসইউ/জিকেএস