পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ নিয়ে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছে সাজিদ মীর একটি পরিচিত নাম। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র ওয়েবসাইটে এখনো মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধী হিসেবে এই ব্যক্তির ছবি ঝুলছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে–
Advertisement
২০০৮ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা। ১০টি হামলার ওই সিরিজ আক্রমণে ১৭০ জনের প্রাণহানি ঘটে। তিনদিনের হামলায় নিহতদের মধ্যে ছয়জন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধার উপক্রমও হয়েছিল এই হামলার জেরে। লাহোরে বসে গোটা হামলার নেতৃত্ব সাজিদ মীরই দিয়েছিল বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্র ডনেও তেমনই বলা হয়েছে।
পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, মুম্বাই হামলার আগে দুই বছর ধরে মুম্বাইতে গিয়ে গোটা ঘটনার ছক তৈরি করে। যাবতীয় পরিকল্পনা ও হামলার রূপরেখা তৈরিতে তাকে সাহায্য করে যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবাদী ডেভিড কোলম্যান হেডলি। আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার দায়ে হেডলি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রেই ৩৫ বছর কারাদণ্ড ভোগ করছে।
সাজিদ মীর ১৬ বছর বয়স থেকেই লস্করের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৪ সালে হাফিজ সৌদের সংস্পর্শে আসে সে। ডন লিখছে, সেই বয়সেই জঙ্গিবাদীদের আন্তর্জাতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে সাজিদ। ধীরে ধীরে সে হয়ে ওঠে লস্করের দুনিয়াজুড়ে জঙ্গিবাদী জাল বিস্তারের অন্যতম শীর্ষকর্তা। প্রতিবেদনে তাকে লস্করের আন্তর্জাতিক ক্রীয়াকর্মের উপ-প্রধান বলা হলেও স্বীকার করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে সেই প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। পাকিস্তানের জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের প্রধান জাকি-উর-রেহমান-লকভির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল তার। ডন’র প্রতিবেদনেও স্বীকার করা হয়েছে আল-কায়দার সঙ্গেও সাজিদ মীরের যোগাযোগের কথা।
Advertisement
২৫ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ২০০৫ সালে ক্রিকেট অনুরাগী পরিচয় দিয়ে গোপনে ভারতে ঘুরে যায় সাজিদ মীর। দুই দেশের ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালে ১৫ দিন ভারতে ছিল সে। অথচ ২০০২ সালে ভার্জিনিয়ার কিছু সহযোগীর সাহায্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার সময়ই আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে তার যুক্ত থাকার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
‘ভার্জিনিয়া পেন্টবল জিহাদি’ নামে পরিচিত ১১ জনের মধ্যে ১০ জন এফবিআই’র হাতে ধরা পড়ে জেলবন্দি হতেই বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আফগানিস্তানে অস্ট্রেলিয়ার সেনা থাকার কারণে সাজিদ মীর ২০০৩ সালে ফরাসি নাগরিক উইলি ব্রিগেট এবং অস্ট্রেলিয়ান ফাহিম খালিদ লোধিকে সঙ্গে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ও জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করেছিল।
সন্ত্রাসে যুক্ত থাকার অপরাধে ২০০৬ সালে লোধিকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয় সেখানকার আদালত। অস্ট্রেলিয়া থেকে বিতাড়িত উইলিকেও ফ্রান্সের আদালত ৯ বছরের কারাদণ্ড দেয়। এরপর ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায় সরাসরি নেতৃত্বে ছিল সাজিদ মীর। ২০০৯ সালে হেডলিকে সঙ্গে নিয়ে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সংবাদপত্র দপ্তরেও জঙ্গি হামলায় তার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে ডন।
আর এনাকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এমন এক ব্যক্তিকে নিজের পেটের ভেতর পুরে পাকিস্তানের হয়েছে উভয় সংকট। একদিকে নিজেদের কর্মকৌশল হিসেবে সাজিদ মীরকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারছে না দেশটি। আবার গিলে ফেলাটাও কঠিন।
Advertisement
জঙ্গিবাদীদের অর্থায়নের বিষয়ে নজরদারির আন্তর্জাতিক সংস্থা ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ)-এর ধূসর তালিকা বড় খারাপ জিনিস। এ থেকে থেকে বাঁচতে একরকম মরিয়া পাকিস্তান। এমনিতেও দেশটির সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর প্রায়। ফলে নিজেদের জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগের যাবতীয় তথ্য-প্রমাণ আড়াল করতে সবরকম চেষ্টা চালাচ্ছে ইসলামাবাদ।
এরই অঙ্গ হিসেবে এবারও লস্কর-এ-তৈয়বার কট্টক জঙ্গিবাদী নেতা সাজিদ মজিদ মীরকে কারাদণ্ড দিয়ে জেলে ভরা হয়েছে। আগেও অবশ্য নিজেদের জঙ্গিবাদীদের অর্থায়নের অভিযোগ থেকে বাঁচাতে একই ধরনের কাজ করেছে পাকিস্তান, ফলে বিষয়টিকে ‘নাটক’ বলে অভিহিত করছেন কেউ কেউ। যদিও সাজিদ মীরকে নিয়ে ইসলামাবাদের এবারের ‘নাটক’ নিজ দেশেরই জাতীয় পত্রিকা ডন-এ ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।
ডন’র প্রতিবেদন বলছে, সাজিদ মীর ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। জুন মাসে লাহোরের অ্যান্টি টেরোরিজম কোর্ট তাকে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের দায়ে ১৫ বছর ৬ মাসের জন্য জেল এবং ৪ লাখ ২০ হাজার রুপি জরিমানা করে। ডন’র খবর অনুযায়ী বর্তমানে সে কোট লখপত জেলে বন্দি। পত্রিকাটি অবশ্য সাজিদ মীরের গ্রেফতার নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কারণ সাজিদ মীরের মতো হাই প্রোফাইল সন্ত্রাসীকে অত্যন্ত নীরবে গ্রেফতার করা হয়।
আদালতের নির্দেশও তেমন একটা প্রচার পায়নি পাকিস্তানে। এটাই ডন’র বিস্ময়ের কারণ। অথচ গত এপ্রিল মাসেই তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানা যায়। তাহলে সরকার মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে কেন এই প্রশ্নের উত্তর নেই। আরও বিস্ময়ের কারণ হলো ইসলামাবাদ আগে জানিয়েছিল সাজিদ মীর মারা গেছে।
পশ্চিমা দেশগুলো সেই বক্তব্যকে বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে সাজিদ মীরের মৃত্যুর প্রমাণ দিতে বলেছিল পাকিস্তানকে। এফএটিএফ জঙ্গিবাদীদের অর্থায়নের কারণে সাজিদ মীরকে হাতিয়ার করে বড় ধরনের শাস্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে ইসলামাবাদকে। এটা টের পেয়েই লস্করের কট্টর নেতাকে জেলবন্দি করার নাটক করে পাকিস্তান গোটা দুনিয়াকে বোকা বানাতে চাইছে -এমনটাই মত ডন’র।
পাকিস্তানি পত্রিকাটির সোজাসাপ্টা কথা, এফএটিএফ’র হাত থেকে বাঁচতেই শাজিদ মীরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই গ্রেফতারের মাধ্যমে ইসলামাবাদ বোঝাতে চাইছে জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে নিজেদের কর্তব্য পালন করে চলেছে পাকিস্তান। সাজিদ মীরকে গ্রেফতার করে এফএটিএফ-কে বোকা বানানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছেও নিজেদের জঙ্গিবাদবিরোধী বলে প্রমাণ করতে চায় ইসলামাবাদ। কারণ এফএটিএফ’র সবচেয়ে বড় পর্যবেক্ষণ ছিল জঙ্গিবাদীদের গ্রেফতার ও শাস্তিদানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অনীহা। জঙ্গিবাদীদের শাস্তির হার কম থাকায়ই তাদের ধূসর তালিকায় রাখা হয়েছিল বলে ডন মনে করে।
ডন-এ প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এফএটিএফ’র জুন মাসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে পাকিস্তান মানি লন্ডারিং বা অর্থপাচার মামলার তদন্ত ও বিচারে ‘ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা’ দেখিয়েছে। পাশাপাশি বোঝানোর চেষ্টা করেছে জাতিসংঘের মনোনীত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সিনিয়র নেতা এবং কমান্ডারদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে অর্থায়নের মামলাগুলি তারা গুরুত্ব সহকারে অনুসরণ করছে।
ডন লিখেছে, “ওয়াচডগ (এফএটিএফ) অবশেষে বুঝেছে পাকিস্তান ৩৪টি শর্ত পূরণ করে দুটি কর্ম পরিকল্পনা ‘যথেষ্টভাবে সম্পন্ন’ করেছে এবং মানি লন্ডারিং ও জঙ্গিবাদে অর্থায়ন বিরোধী নীতি কার্যকর করতে একটি কারিগরি দলকে নির্দেশ দিয়েছে। পাকিস্তান নিশ্চয়তা দিয়েছে তারা প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে টেকসই এবং সমর্থনযোগ্য অবস্থান বজায় রাখবে।”
ডন’র লেখায়ই স্পষ্ট, পাকিস্তান সাজিদ মীরকে গ্রেফতার দেখিয়ে এফএটিএফ’র ধূসর তালিকা থেকে বের হতে মরিয়া। কারণ জঙ্গিবাদীদের অর্থায়নে শুধু সাজিদ মীর বা পাকিস্তানের কিছু সংগঠনই জড়িত নয়, তাদের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই’র শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ।
এহেন কুখ্যাত আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী নেতাকে গ্রেফতর করে জঙ্গিবাদীদের অর্থায়নে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। এফএটিএফ পাকিস্তানের সঙ্গে জঙ্গিবাদীদের সুসম্পর্কের কথা জানে। তাই ধূসর তালিকায় রাখা হয়েছে তাদের। এখন কালো তালিকাভুক্ত করারও দাবি উঠছে।
এ অবস্থায় নামকাওয়াস্তে গ্রেফতার করে কুখ্যাত আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদী নেতাকে জেলের ভিতরই জামাই আদরে রেখে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। এখন দেখার পাকিস্তানের ফাঁদে পা দিয়ে এফঅটিএফ জঙ্গিবাদীদের অর্থায়ন বন্ধে নিজেদের অবস্থানে অটল থাকতে সক্ষম হয় কি না।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস