রান্নার প্রশংসা করলে রাঁধুনি খুশি হন। খুশি হয়ে পাতে অতিরিক্ত মাছ-তরকারি পরিবেশনের অভিপ্রায়ে জোর-জবরদস্তি করেন। আমার বেলায় এ রকম কিছু ঘটল না। এর কারণ কী?
Advertisement
খাওয়া শেষে কারণ উদ্ঘাটিত হলো। হাত-মুখ ধুয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই কঠিন মুখে লবণ বেগম উচ্চারণ করল- : বসলা কেন? বিস্মিত হলাম। রাতের খাবার খেয়ে কেউ কেউ হাত-পা ছড়িয়ে শুধু বসেন না, সুযোগ থাকলে বিছানায় শুয়ে পড়েন। আমি অতদূর যাইনি; কাত হয়েছি মাত্র। তাতেই এই ব্যবহার! মনের কষ্ট মনে রেখে বললাম- : বসলে সমস্যা কী? : আমি তো বাবু সমস্যার কথা বলি নাই! : তাইলে? : তুমি খাইতে বইসা রান্না অতি চমৎকার হইছে- বার বার এই কথা বলতেছিলানা? : হ। বলতেছিলাম। : প্রশংসাপত্র জায়গা মতো পৌঁছাইতে হবে না? : জায়গা মতোই তো পৌঁছাইছি! : উহুঁ। তোমার প্রশংসা ভুল জায়গায় পৌঁছাইছে। এই তরকারি আমিরান্না করি নাই। : কে করছে? : চিনি বেগম।
অঃ। ঘটনা তাহলে এই? ক্যাবলা-হাসিতে চোখ-মুখ উদ্ভাসিত করে বললাম- : খাবার মুখে দিয়া সুস্বাদু মনে হইছে- সেইটাই তোমারে জানাইছি। এইটা এখন মাইকিং করার দরকার আছে? : দরকার আছে দেইখ্যাই তো যাইতে বলতেছি। যাও। সংসার জীবনে সুখী হওয়ার যে ক’টি গোপন মন্ত্র আছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্ত্রীর অনুগত হওয়া। তার আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে মান্য করা। লবণ বেগমের হুকুম পালন করতে পাশের ফ্ল্যাটে হাজিরা দিলাম। গৃহকর্ত্রী অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। হাত কচলাতে-কচলাতে তাকে বললাম- : খাইতে বইসা রান্নার প্রশংসা করতেছিলাম। খাওয়া শেষে আপনের আপা বললেন, প্রশংসার বস্তা জায়গা মতো পৌঁছাইয়া দিয়া আস। প্রশংসায় খুশি হয় না- জগতে এমন মানুষ বিরল। চিনি বেগম খুশি হলেন। তিনি আমাকে বসতে বলে চায়ের আয়োজন করার জন্য পা বাড়াতেই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম- : মাফ করবেন। এখন চা খেতে পারব না। আমার ছটফটানি ভাব দেখে চিনি বেগমের মুখে কৌতুকের পারদ নাচানাচি করতে লাগল। কপালের ওপর লুটিয়ে পড়া চুলগুলো একপাশে সরিয়ে তিনি বললেন- : তা কী করে হয়! এই প্রথম আপনি আমার বাসায় এলেন। বেশি দেরি হবে না। প্লিজ, বসুন। প্রবল বেগে ধেয়ে আসা স্রোতধারা লক্ষ্য করে কোনো রমণী যদি উচ্চারণ করে প্লিজ, থেমে যাও; আমার ধারণা, স্রোতের গতি শূন্যে নেমে আসবে। রমণী যদি বলে হে বায়ু, প্লিজ, দিক পরিবর্তন কর; বায়ু তার অনুরোধ ফেলতে পারবে না। যে নারী জাতির মুখে প্লিজ শব্দ শুনে প্রকৃতি পর্যন্ত বশ মানে, সেখানে আমি আদমের সাধ্য কী, তা উপেক্ষা করি? চায়ের কাপ হাতে দিয়ে চিনি বেগম হেসে বললেন- : চাঁনখারপুলে আপনের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার ঘটনা মনে আছে? : জি, আছে। : ওইখান থেকে যে মুরগির খাঁচা কিইন্যা আনছিলাম- তার ফল পাইছি গতকাল। ডিমগুলা হাতে লইয়া ভাবলাম, আপনেরে এর ভাগ নাদিলে অন্যায় হবে। কিন্তু শুধু ডিমের তরকারি কেমনে দেই! তাই ডিম-মুরগি একসঙ্গে মিলাইয়া রান্না করছি। চা পর্ব শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। চিনি বেগম জানতে চাইল- : আগামীকাল তো আপনের ছুটি? : জি। : বিকেলে আমারে একটু সময় দিতে পারবেন? : কী বিষয়ে, বলেন তো! : আপনারে লইয়া একটা জায়গায় যাব। : কোথায়? : আসাদ গেটের দিকে।
: দেখি।
Advertisement
: দেখি না, বলেন যাবেন- প্লিজ।
আবার প্লিজ! মৌনতাকে সম্মতির প্রতিরূপ হিসেবে প্রতিস্থাপন করে বাসায় ঢুকতেই লবণ বেগম বলল- : বস্তারমুখ খুলতে সমস্যা হইতেছিল নাকি? : মানে? : মুখের দুইটা কথা বলতে এত সময় লাগার কথা না। তাই ভাবলাম, প্রশংসা ভর্তি বস্তার মুখ খুলতে যাইয়া কোনো সমস্যায় পড়লা কি না।
: ভালোই ভাবছ! ঘটনা হইল, উনি চা না খাইয়া আসতে দিলেন না। : চাখাইছো? : খাইছি। : চা নিশ্চয়ই তরকারির মতো ভালো হইছে? : হুঁ। তা হইছে। : ভালোরে ভালো! সবই ভালো। পরস্ত্রীর সালুন ভালো-চা ভালো। চলনভালো-বলন ভালো। হাসি ভালো, এমনকি কাশিও ভালো।
লবণ বেগম কোন জায়গায় খোঁচা মারল, বুঝতে পারলাম। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানদের পরামর্শ হচ্ছে, গৃহিণী যখন কথা বলবে, তখন তুমি বোবা হয়ে যাও। কথার পিঠে কথা যোগ করতে গেলে বিপদ। শুধু বিপদ নয়, মহাবিপদ। সাধারণত বিপদ-আপদজাতীয় বিষয়গুলো আমি সযত্নে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। আজও তাই করলাম।
Advertisement
পরদিন বিকেলে চিনি বেগমের সঙ্গে যার কাছে গেলাম, তার নাম বরকতউল্লাহ। বরকত সাহেবের প্রতিভার বহর দেখে মুগ্ধ হলাম। তিনি একাধারে শিক্ষক, সাংবাদিক, নাট্য পরিচালক ও প্রযোজক। কথাবার্তার একপর্যায়ে তার কাছে জানতে চাইলাম-
: যেহেতু নামের ডগায় শিক্ষক সংযুক্ত আছে, তাই আপনাকে স্যার বইল্যা সম্বোধন করা যায়। বলেন তো স্যার, আসলে আপনের মূল পেশা কী? বরকত স্যার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন- : আমার মূল পেশা হইল শিক্ষকতা। শিক্ষকতা করার একপর্যায়ে টের পাইলাম, আমার মধ্যে আরও প্রভিতা আছে। প্রতিভা লুকাইয়া রাখার জিনিস না। তাই সবগুলারে উন্মোচন কইরা পাবলিকের উপকার করার কাজে নিয়োজিত আছি। : মানুষের উপকার করা জগতের ভালো কাজগুলার মধ্যে একটা। আপনি এই মহৎ কর্মে নিযুক্ত আছেন এজন্য আপনেরে লাখ-কোটি সেলাম। তবে স্যার, একটা প্রশ্ন...
: কীপ্রশ্ন? : একসঙ্গে এতগুলারে আপনে সামাল দেন কেমনে? আমার তো এক চাকরির ডিউটি করতে যাইয়াই দম বাইর হইয়া যায়। আমার কথায় বরকত স্যার হা-হা করে কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন- : সবই হইল প্রতিভা। কবি নজরুল লেটোর গান করছেন। গদ্য-পদ্য রচনা করছেন। বাঁশি বাজাইছেন। যুদ্ধে জয়েন করছেন। আবার সাংবাদিকতাও করছেন।
কবি নজরুলের সাংবাদিকতা আর এ যুগের সাংবাদিকতার মধ্যে অনেক তফাত। কোনো সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি যখন বাসা বাঁধে, তখন এটাকে উপজীব্য করে সুবিধাভোগীর সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হওয়ায় আজকাল মানুষ সাংবাদিক ও রাজনীতিক হওয়ার জন্য উন্মুখ।
সবাই সাংবাদিক হতে চায়। সবাই রাজনীতিক হতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের পরিচয় ব্যবহার করে লাভবান হওয়া। কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসার পথে রাজনৈতিক অঙ্গনের মহারথীদের পরিচয় ব্যবহারের ব্যাপক আয়োজন চোখে পড়ল। জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী বাজার পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য বিশাল বিলবোর্ড ও ব্যানার।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসকে কেন্দ্র করে টাঙানো এসব বিলবোর্ড ও ব্যানারে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা তাদের মনের ক্ষোভ ও ভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিলবোর্ড ও ব্যানারগুলোর এক কোনায় বঙ্গবন্ধু আছেন বটে, তবে অনুসারী-অনুগামীদের তুলনায় অনেকটাই ম্রিয়মাণ। নেতাকর্মীরা বাহারি পোশাকে শরীর ঢেকে ছবি তুলেছেন; হাসিমুখের সে ছবির নিচে নিজের নাম ও পরিচয় বড় বড় অক্ষরে লিপিবদ্ধ করেছেন। তার মানে বঙ্গবন্ধু উপলক্ষ মাত্র। বাঙালির অসংবাদিত এ নেতাকে সামনে রেখে নিজের পরিচয় ও ব্যাপ্তি তুলে ধরাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য।
বিলবোর্ডও ব্যানারে শোভা পাওয়া অসংখ্য নেতাকর্মীর মুখচ্ছবি গুনতে গুনতে সামনের দিনে এতসব নেতাকর্মীর মূল্যায়নের কাজটা কীভাবে সম্পন্ন হবে ভেবে আঁতকে উঠলাম। ভবিষ্যতে এরা সবাই যদি এমপি হতে চায়, মন্ত্রী হতে চায়, তাহলে ভয়ানক বিপদ। চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মিল না ঘটলে তখন এরা যদি সোমালিয়া, উগান্ডাসহ আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো নিজ নিজ এলাকায় দখল প্রতিষ্ঠা করে লড়াইয়ে লিপ্ত হন- তাহলে দেশে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যাবে। সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হবে। আনমনা হয়ে এসব ভাবছিলাম, চিনি বেগমের কথায় সম্বিত ফিরল। চিনি বেগম একটা পেপার-কাটিং বরকত স্যারের সামনে রেখে বললেন- : এই বিজ্ঞাপন দেইখ্যা আপনের কাছে আসছি। বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানে লেখা লেডি টিচার দিচ্ছি, নিচ্ছি। বিষয়টা লক্ষ্য করে বরকত স্যারের উদ্দেশে বললাম- : আপনের দেখতেছি আরও প্রতিভা আছে। : এইটা ঠিক প্রতিভা না, এইটা হইল সাইড বিজনেস। শিক্ষক পরিচয় পাইয়া অনেকেই আমার কাছে তাদের সন্তানের জন্য ভালো হাউস টিউটর চায়। তাদের উপকারের জন্য; এই আর কী... : শুধু লেডি টিচার কেন, পুরুষ টিচাররা কী দোষ করছে? : পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অধিক দায়িত্ব সচেতন। মূলত এজন্যই রিক্রুট করার জন্য আমি লেডি টিচারদের বাইছ্যা নিছি।
বরকত স্যার একটা ফরম বের করে চিনি বেগমের হাতে দিলেন। ফরম পূরণের পর রেজিস্ট্রেশন ফি হিসেবে এক হাজার টাকা নিয়ে এক সপ্তাহ পরে যোগাযোগ করতে বলা হলো। বাইরে এসে চিনি বেগমকে বললাম-
: আপনে টিউশনি করবেন? : অসুবিধা কী? পাস কইরা বাসায় বেকার বইসা রইছি। টিউশনি করলে সময়টা কাটবে, সঙ্গে কিছু টাকাও পাওয়া যাবে। : আপনে কোনো চাকরি-বাকরির চেষ্টা করেন নাই? : করছি। কোনো লাভ হয় নাই। যে দেশে বিসিএস থেকে শুরু কইরা সব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়, চাকরির নাম মুখে লইলেই মন্ত্রী-এমপির সুপারিশ লাগে, নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকার ঘুস জোগাড় করতে হয়, সেখানে আবেদন-নিবেদন পর্বেই সার্টিফিকেট অনেক তরুণ-তরুণীরে মরহুম ঘোষণা করে। আমার বেলায়ও একই ঘটনা ঘটছে।
বাস্তবতা কঠিন, জানি। তবে অনেক সময় বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে অন্যরকম কিছু করতে সাধ হয়। আসাদ গেটের পাশেই আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন। নৈসর্গিক পরিবেশের বুকে লুই কানের মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যশৈলী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্থাপত্যশৈলী চারপাশে বিছানো সবুজ ঘাসের চাদরের উপর বসে চিনি বেগমের সঙ্গে দু’দণ্ড সময়কাটালে খুব বেশি অন্যায় হবে কি? ন্যায়-অন্যায় পরের কথা, সাহসই পেলাম না। ফার্মগেটে একটা কাজ আছে বলে চিনি বেগমের কাছ থেকে পালালাম।
মাসখানেক পরে চিনি বেগমের সঙ্গে দেখা হলো। জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনের টিউশনি কেমন চলতেছে?
চিনি বেগম হাসলেন। হাসির ধরন দেখে মনে হচ্ছে, মানুষ যখন নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করতে বসে, তখন তাদের মুখে এ ধরনের হাসি শোভা পায়। চিনি বেগম বললেন-
: আবার বলবেন না ভাই, একটা টাউটের পাল্লায় পড়ছিলাম। আমার এক হাজার টাকাই গচ্চা গেছে। : কেন, কী হইছে! : কথা মতো এক সপ্তাহ পরে ওই লোকের কাছে ফোন করলাম। ব্যাটা বলে কী জানেন? বলে, ভালো একটা পাণ্ডুলিপি হাতে পাইছি, আপনেরে আমার পরবর্তী নাটকের নায়িকা বানাইতে চাই। রাজি আছেন কি না বলেন। : আপনে কী বললেন? : আমি বললাম, নায়িকা-ফায়িকার দরকার নাই। আমার মাস্টারি পাইলেই চলবে। : তারপর? : তারপর আর কী! এখন দুইদিন পরে পরে ফোন করে আর বলে, আপা, আপনের ফিগার ভালো, উচ্চারণ ভালো, আপনে নায়িকা হইলে সুপারহিট হবেন ইত্যাদি। : আহারে! এত কইরা বলতেছে, রাজি হইয়া যান। চিনি বেগম এবার প্রাণখোলা হাসি হাসলেন। বললেন- : আপনে কি পাগল হইছেন! সবকিছু হওয়া শেষ। এখন বাকি রইছে শুধু নায়িকা হওয়া, তাই না? : কিন্তু নায়িকা না হওয়া পর্যন্ত তো এই লোক আপনেরে জ্বালাইয়া মারবে। আপনে এক কাজ করেন। এর বিরুদ্ধে থানায় একটা জিডি কইরা রাখেন। চিনি বেগমের কণ্ঠে হাহাকার ধ্বনিত হলো। আমার বোকামি দেখে ভর্ৎসনার সুরে তিনি বললেন- : আপনের কি ধারণা, এই ধরনের টাউটরা পুলিশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন না কইরাই টাউটামি করতেছে?
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
এইচআর/এমএস