‘আমাগো এহন (এখন) কঠিন অবস্থা। একদিন কাম (কাজ) করলে ৫০০ টাকা পাই। তাও সবদিন কাম থাকে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম খালি বাড়তেই আছে। তাতে না খায়েই (খেয়েই) মরা লাগবো। এত কষ্টের পরও সরকারের মন্ত্রীরা কয় আমরা নাকি বেহেশতে আছি! তয় (তবে) বেহেশতে ভাই আমরা গরিব মানুষরা নাই। বেহেশতে আছে সরকারের মন্ত্রী আর নেতারা।’
Advertisement
আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার জুনি কালসা গ্রামের দিনমজুর মো. ঝন্টু মিয়া।
একটি বেগুন ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কারের কাজ করছিলেন ঝন্টু মিয়া। প্রচণ্ড রোদ আর গরমে শরীর থেকে টপ টপ করে ঘাম ঝরছিল। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তিনি জানান, তার চার ছেলেমেয়ে। তিনজন স্কুলে লেখাপড়া করে। সংসারের খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন তার হিমশিম অবস্থা। দুবেলা খাবার জোটানোই যেখানে কষ্টের সেখানে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর খরচ নিয়ে চিন্তিত ঝন্টু মিয়া।
স্ত্রী আর মা-বাবাকে নিয়ে সংসার একই গ্রামের দিনমজুর চান মিয়ার। সংসারে তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো নাই। ৫০০ টাকা রোজে কাম (কাজ) করি। বাজারে চাল, ডাল, তেল, তরিতরকারি সবকিছুরই দাম বেশি। চাহিদামতো বাজার করতে পারি না। সংসার চালাতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। এইভাবে ক্যামনে চলুম বলেন? এইভাবে চলা তো আর সম্ভব হচ্ছে না।’
Advertisement
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজার। শহর কিংবা গ্রাম সবখানেই পড়েছে এর প্রভাব। তবে সবচেয়ে বিপাকে আছেন গ্রামের নিম্নআয়ের মানুষজন। সারা বছর এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের সংসারে। তার ওপর হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা পরিবারগুলো।
এদেরই একজন হযরত আলী (৫০)। পেশায় একজন ভ্যানচালক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘খুব কষ্টে আছি, স্যার। গরিব মানুষ অভাবের সময় মরিচ ডইলা (ডলে) আর শাক দিয়া ভাত খায়। কিন্তু এহন (এখন) মরিচ আর তেলের দাম এত যে সে উপায়ও নাই। আমাগো এহন মরণদশা। বাড়ি গেলেই অশান্তি হয়। ঠিকমতো কামাই রুজি নাই। সদাই (জিনিসপত্র) নিতে পারি না।’
নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য সরকার তো কম মূল্যে টিসিবি পণ্য বিক্রি করছে। আপনি কি সেই সুযোগ পাচ্ছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ভ্যানচালক হযরত আলী বলেন, ‘সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রামের গরিব মানুষ পায় না। যারা মধ্যবিত্ত-চালাক-চতুর তারা পায়। আর মেম্বার-চেয়ারম্যানের যারা নির্বাচন করে তারা মাল পায়। আমরা তো ইলেকশন করি না। পেটের দায়ে ব্যস্ত থাকি।’
রহিজ উদ্দিন নামের একজন মাটিকাটা শ্রমিক জানান, স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে তার সংসার। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় এখন এমনিতেই কাজ নেই। তার ওপর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘এক পোয়া কাঁচা মরিচ কিনতে হয় ৭৫ টাকা দিয়ে। চাল, ডাল, তেল—সব জিনিসের দামই বেড়েছে। কাজ-কাম নাই। কী করমু, তাই ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। দুদিন আগে একটি এনজিও থেকে নতুন কইরা ঋণ আনছি। কিন্তু কিস্তি দিমু ক্যামনে তাই চিন্তা করতাছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর থেকেই মানিকগঞ্জের বাজারগুলোতে অস্থির অবস্থা। যোক্তিক কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে অনেক পণ্যের দাম। বাজার নিয়ন্ত্রণে শহরাঞ্চলে মাঝে মধ্যে অভিযান চললেও গ্রামাঞ্চলের হাট-বাজারে নেই প্রশাসনিক মনিটরিং। তাই নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়ানোর দাবি ভুক্তভোগীদের।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান রুমেল জাগো নিউজকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছেন।
তিনি বলেন, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দামের ফারাক অনেক। যেখানে যৌক্তিকভাবে এক টাকা বাড়ার কথা সেখানে ৩-৪ টাকা বাড়ানো হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে।
এসআর/জিকেএস