জীবন একটি সমরক্ষেত্র। জীবনে বিভিন্ন দিকে বিভিন্নভাবে ভালো-মন্দ থাকবেই। ভালোটাকে গ্রহণ করে মন্দটাকে মুছে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। আর এই ভালো-মন্দ বিবেচনা করতে হলে অবশ্যই সেই চেতনাবোধটি থাকতে হবে। চেতনাবোধহীন মানুষ অবিবেচক ও সমাজের জন্য কলঙ্কিত। সবার একটি আদর্শ থাকে বা থাকতে হয়। সেই আদর্শ নিয়ে জীবন চলতে হয়। এমনি একটি আদর্শের নাম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
Advertisement
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাতের সাত প্রহরের পর অষ্টম প্রহরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। তখন মধ্যরাত। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে, সপ্তমী তিথি ১৮ আগস্ট রাত ০৯.২০ পর্যন্ত চলবে এবং এর পরে অষ্টমী তিথি শুরু হবে, যা পরের দিন অর্থাৎ ১৯ আগস্ট রাত ১০টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত থাকবে। তাই জন্মাষ্টমীর উৎসব পালিত হতে পারে ১৮ আগস্ট মধ্যরাতে ১২টায়। তবে জ্যোতিষীদের মতে, ১৯ আগস্ট জন্মাষ্টমী উদযাপন করা খুব ভালো হবে।
সংস্কৃতে ‘কৃষ্ণ’ শব্দের অর্থ ‘কালো’। ব্রাহ্মণ সাহিত্যে কৃষ্ণকে নীল মেঘের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুসারে দ্বাপর যুগের শেষভাগে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মথুরায় কংসের কারাগারে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণের এই জন্ম তিথিকে ঘিরে উৎসবের আয়োজন করা হয়।
ইতিহাসবিদদের বিবেচনায় ১০০০-৯০০ খ্রিস্টপূর্বে সনাতম ধর্মের প্রাণপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। তাঁর জন্মের সময় এই বিশ্বব্রহ্মান্ড পাপ ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ ছিল। তাই মানব জাতিকে রক্ষার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে। নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মানব জাতির কাছে জীবন ধারণের অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন।
Advertisement
শ্রীকৃষ্ণের বাণী সমগ্র বিশ্বকে আলোড়িত করছে হাজার হাজার বছর ধরে। শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা হলো- সংঘর্ষ ও অন্যায়কে পরাভূত করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এই পবিত্র দিনে সব অকল্যাণ ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অন্তর আত্মাকে জাগ্রত করার শপথ নিতে হবে।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার হয়ে শ্রীকৃষ্ণ এই দিন জন্ম নিয়েছিলেন মা দেবকীর গর্ভে। ছোটবেলায় তাঁকে সবাই আদর করে গোপাল বলে ডাকত। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে এই দিন শ্রীকৃষ্ণ বা গোপাল পূজার আয়োজন করা হয়। তিনি গোবর্ধন পর্বতকে এক আঙুলে তুলেছিলেন বলে তাঁর আরেক নাম গোবর্ধন। কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীকে কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিনী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী এবং শ্রীজয়ন্তীও বলা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে কৃষ্ণ ছিলেন স্বয়ং ঈশ্বর। দুষ্টের দমন করে পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন।
দ্বাপরের যুগসন্ধিক্ষণে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে জন্ম নেওয়া সনাতন ধর্মের মহাবতার শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব পালিত হয়। দ্বাপর যুগে অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে। ধর্ম ও ধার্মিকরা অসহায় হয়ে পড়েন। বসুমতী পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন।
ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা মিলে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে সবাই মিলে বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণির দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তাঁদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ।
Advertisement
ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দেন ধরাধামে তাঁর লীলার সহচর হওয়ার জন্য। বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাঁদের নিজ নিজ পত্মীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্ত্যলোকে অবতরণশ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। গীতায় স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, ‘আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর (শাসক, নিয়ন্ত্রা স্রষ্টা) হয়েও নিজ প্রকৃতিকে (অনির্বচনীয় মায়াশক্তিকে) আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।’
পাশবিক শক্তি যখন সত্য সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবতগীতার শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ অবতারেরও দুটি উদ্দেশের দুটি দিক হলো, অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন ও বাহ্য জগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু এটাই শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য নয়। যুগে যুগে অনেকেই অবতার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। তবে এসব অবতারের অসুর বিনাশ নেই, এসব অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম-পবিত্রতা-জ্ঞান-ভক্তির অনুপ্রেরণা দেওয়া। পক্ষান্তরে পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর বিনাশ ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুটিই উদ্দেশই বিদ্যমান।
বেদে বলা আছে ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি খুবই কঠিন কাজ। মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাকেই ভগবান বা ঈশ্বর নামে ডেকে থাকি।
কেবল সনাতনীকল্প মণীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শতনামে সম্ভাষিত হয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, তিনি সে নামে সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাকক্ষে তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণ নামে। তাঁর জন্মলীলাই জন্মাষ্টমী নামে অভিহিত ও স্মরণীয়।
চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি নহুশের পুত্র। যযাতির যদু, তুর্বসু, দ্রুহ্যু, অণু ও পুরু এই পাঁচ পুত্র। এর মধ্যে যদু সবার বড়। শ্রীীকৃষ্ণ এই যদুবংশে মহাত্মা বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। বসুদেবের পুত্র বলে তিনি বাসুদেব নামেও ভক্তদের কাছে পরিচিত। কৃষ্ণানুসারীদের মতে ও সংখ্যাতত্ত্ববিদদের ধারণায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩২২৮ অব্দে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর জন্মতিথি নিয়ে মতান্তরও আছে। মতান্তর যাই থাক না কেন, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তাঁর ভক্তদের কাছে ‘জন্মাষ্টমী’ হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
আমার যে ধর্মের কথায় বলি না কেন সারকথা একই। অন্যায়ের সঙ্গে আদিকাল থেকেই ন্যায়ের যুদ্ধ চলে আসছে। আর অন্যায় যে কোনো দিনও টিকতে পারেনি, ইতিহাস তারই সাক্ষ্য বহন করে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনচরিত আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে সব সময় ন্যায়ের পথে চলতে হবে। তুমি নিষ্কাম হও এবং কাজ করে যাও। ফলের আশা করো না- কৃষ্ণ এবং অর্জুনের এই মিথলজিক্যাল সংলাপটি যোগাযোগবিদ্যার জায়গা থেকে ভীষণ শক্তিশালী একটি উক্তি।
সনাতন ধর্ম মতে, অধর্ম ও দুর্জনের বিনাশ এবং ধর্ম ও সুজনের রক্ষায় কৃষ্ণ যুগে যুগে পৃথিবীতে আগমন করেন। অপশক্তির হাত থেকে শুভশক্তিকে রক্ষার জন্য শ্রীকৃষ্ণ মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসকে হত্যা করে মথুরায় শান্তি স্থাপন করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ভাব ও দর্শন যুগ যুগ ধরে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। কৃষ্ণের প্রেমিকরূপের পরিচয় পাওয়া যায় তার বৃন্দাবন লীলায়, যা বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল প্রেরণা।
আমরা যদি মহৎ ব্যক্তিদের জীবনের আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কখনোই অন্ধকারে ছেয়ে যায় না। তবে বড়ই পরিতাপের বিষয়, আমরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। তারপরও শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মতিথিতে আমাদের চাওয়া হোক তাঁর আদর্শ, তাঁর শিক্ষা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব সামনের দিকে এবং জাগ্রত থাকব সকল অশুভর বিপক্ষে। এই শুভ চেতনা হোক সকলের শপথ। জন্মাষ্টমী শুভ হোক সকলের ।
উৎসব অর্থই আমার কাছে ভেদাভেদ ভুলে মিলন মেলা। উৎসব অর্থই আমার কাছে দূরত্বের বাধন ভেঙ্গে একমতে পৌছানো। যদি তাই না হবে তাহলে যুগে যুগে কেন উৎসব আসবে? এই সকল উৎসবের পটভূমি ও তাৎপর্য কি?
আমরা যদি একটি আদর্শ মেনে চলি তাহলেই পৃথিবীতে কমে আসবে নৈরাজ্য ও অশুভর দৌরাত্ম্য। হোক সেটা ইসলাম, হিন্দু কি বৌদ্ধ। তাই বারংবার মনে হয় ধর্মীয় শিক্ষা জাগ্রত হোক। দূরে যাক জগতের অশুভ। শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী তিথিতে এটাই হোক আদর্শ।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম