মতামত

উত্তরার রাস্তায় ৫ মৃত্যুর দায় কার?

দেশে প্রতিদিন নানা কারণে মানুষের মৃত্যুর সংবাদ হয়। পানিতে ডুবে মরে, গাড়ি চাপায় মরে, ডায়রিয়ায় মরে, ডেঙ্গু জ্বরে মরে। এই তো কয়দিন আগেই রেললাইনের সিগন্যাল না থাকায় রেলগাড়ির নিচে কাটা পড়ে কতগুলো তাজা প্রাণ ঝড়ে গেলো।

Advertisement

গত প্রায় দুই বছরে করোনায় মারা গেলো। কিন্তু উত্তরায় গত সোমবার নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছুটে গিয়ে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে যে দুর্ঘটনাটি ঘটে গেলো সেটি গোটা দেশের মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। কিছু মৃত্যু আগে থেকেই জানা থাকে, কিছু মৃত্যু একদমই অজানা কারণে ঘটে আবার কিছু মৃত্যু থাকে মানুষের নাগালের বাইরে কিন্তু জানা থাকে যে সেখানে কী হলে মৃত্যু হতে পারে।

যেমন পানিতে পড়ে গেলে সাঁতার জানা না থাকলে মৃত্যু হতে পারে, আগুনে পুড়লে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিতে না পারলে মৃত্যু হবে। এমন প্রতিটারই কোনো না কোনো জানা অজানা কারণ থাকে। উত্তরার এই মৃত্যুর কথা কে কবে কল্পনা করতে পেরেছিল? একটি প্রকল্পের কাজ চলছে সেখানে কাজ করছে বিশেষজ্ঞ কোম্পানি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় যে তারা এ বিষয়ে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই কাজটি করবে।

জানা গেছে, বিআরটির কাজ শুরু হওয়ার পর ২০১২ সালে আরেকবার এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটনা ঘটেছিল। যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করার কারণেই তখন মৃত্যু হয়েছিল। প্রকল্প চলছে ২০২২ সালেও এবং একই কারণে আবারও মৃত্যু। কেবল একটি কোম্পানির অবহেলার কারণে এমন মৃত্যুকে কোন ক্রাইটেরিয়ায় ফেলা যায় আমার জানা নেই।

Advertisement

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই দাবি করেছেন, এটি একটি নিশ্চিত হত্যাকাণ্ড। প্রশ্ন আসতেই পারে যে এটিকে হত্যাকাণ্ড কেন বলা হবে না? কারণ প্রকাশ্যে একটি ব্যস্ত রাস্তায় এমন ভারী জিনিস ওঠানো নামানো হচ্ছে অথচ সেই এলাকায় নেওয়া হয়নি কোনো নিরাপত্তা। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও অবাক হয়েছেন যে, এমন গার্ডার উঠানোর সময়তো মানুষ চলাচল বন্ধ থাকার কথা। সাধারণ সেন্স বলে, যে এলাকায় নির্মাণকাজ চলে সেই এলাকায় সাধারণের চলাচল বন্ধ থাকে। চারপাশে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়।

অথচ কী অবাক কাণ্ড যে কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যতীত সেখানে কাজ চলছে বছরের পর বছর। ওই যে ২০১২ সালেও এই কোম্পানিটির গাফিলতি কেড়ে নিয়েছিল কিছু প্রাণ সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের বিচার হয়েছিল সেটি জানা যায়নি। তখন যদি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হওয়া যেত যে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না। বোঝাই যাচ্ছে যে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল না হয় তারা এমন সাহস দেখায় কেমন করে?

নিহত রুবেলের ছেলে প্রশ্ন রেখেছেন, তার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? এই প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে? আমার জানা নেই। সংবাদে পড়লাম, দায়ী কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। একই সাথে প্রকল্প পরিচালকসহ সব দায়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।

আমরা এটাও জানি যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত দায়িত্ববান প্রশাসকের মতো ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় নির্দেশ পালনের স্তরে গিয়ে। কোনো না কোনো অজানা কারণে আমরা সঠিক শাস্তির জায়গাটিকে নিশ্চিত করতে পারি না। দিনের পর দিন অব্যবস্থাপনা আর জবাবদিহিতার অভাব একদিকে অন্যায়ের পাল্লাকে ভারী করতে থাকে আর অন্যদিকে সরকার ও প্রশাসনের ওপর সাধারণ জনগণের বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটি নড়বড়ে হতে থাকে।

Advertisement

তদন্ত কমিটি হয়েছে। রিপোর্টও হবে। প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কোম্পানির দায় পেয়েছে কমিটি। কিন্তু এতে করে কি মৃত মানুষগুলো ফিরে আসবে? সেই পরিবারগুলো কি এই অকস্মাৎ শোক ভুলতে পারবে? গোটা উত্তরাবাসীর মনে যে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটি মুছে যাবে? কারণ কাজ তো শেষ হয়নি।

মেয়র নির্দেশ দিয়েছেন কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে। কিন্তু কাজ বন্ধ করলেই কি সমাধান চলে আসবে? ভবিষ্যতে তাহলে কারা শেষ করবে এই কাজ? এক কোম্পানির শুরু করা কাজ কি ভিন্ন কোম্পানির সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ও নির্ধারিত বাজেটে শেষ করতে পারবে? কোম্পানি না হয় কালো তালিকায় ঢুকলো কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্ট বাকিদের কী হবে? তাদের কি কোনো শাস্তি আসলেই হবে?

যে কোম্পানি দিনের পর দিন এমন অরক্ষিতভাবে কাজ করে আসছিল তাদের মনিটরিং করার দায়িত্ব কাদের ছিল? কেন তারা আগেই সতর্ক হলো না? উত্তরা এলাকাবাসী বলছে তারা প্রতিদিন সেই রাস্তা দিয়ে চলতো আর মৃত্যুর প্রহর গুনতো। তার মানে সাধারণ মানুষ জানতো যে কাজটি সঠিক নিয়মে হচ্ছিল না। তাহলে কেন যথাযথ কর্তৃপক্ষ খেয়াল করলো না? নাকি খেয়াল করলেও গা লাগায়নি?

এমন অনেক প্রশ্নই করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি বিভাগের যে প্রাপ্য শাস্তি সেটি নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে খুব একটা ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমরা আশায় বুক বাঁধি। শাস্তি দাবি করি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রতিটি জীবন মূল্যবান। দিনশেষে আমরা জনগণ কেবল ভরসাই করতে পারি আর দাবি করতে পারি। শাস্তি নিশ্চিত করা বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রশাসনের সবার। ভবিষ্যতের মৃত্যুকে আটকানোর দায়ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু আবারও প্রশ্ন, আসলেই কি কিছু হবে? এমন পাশবিক মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ডের দায় কার?

লেখক: কলামিস্ট, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম