মতামত

আধুনিক ‘চুল্লি’তে আমাদের বাস

মনে আছে, পুরান ঢাকায় আগুন-কাবাব হয়েছিল মানুষ? বলবেন, সে রকম তো প্রায়ই হয়। এরপর রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলার প্রত্যয় ঘোষিত হয়, কিন্তু সে ঘোষণা বাস্তবায়িত হতে দেখি না আমরা। কাজটা তুলনামূলকভাবে সহজ মনে হলেও আসলে যে সহজ নয়, তা বলাই বাহুল্য।

Advertisement

পুরান ঢাকায় ভূমিকম্প ঘটলে উদ্ধারকারী দল গাড়ি নিয়ে ঢুকবে, এমন রাস্তা নেই। আহত-নিহতদের সরিয়ে আনতে উপযোগী সিঁড়ি পর্যন্ত নেই। আসলে পুরান ঢাকায় কিছু একটা ঘটলেই সেটা ব্রিকিং নিউজ হবে নিঃসন্দেহে। আর তখন নতুন ঢাকার মানুষরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সেসব খবর পড়বেন বা টিভির পর্দায় দেখবেন। নতুন ঢাকার মানুষরা বিপৎমুক্ত, আপাত দৃষ্টিতে এমন মনে হওয়া নিয়ে স্বস্তির ঢেঁকুর তুলতেই পারেন। কেননা, নতুন তো নতুন। ঝকঝকে, তকতকে। সম্ভাব্য বিপদ যেটা, সেটা তো ভূমিকম্প। ভূমিকম্প সহনশীল রডের বিজ্ঞাপন টিভিতে হরহামেশা দেখায়, ব্যবহৃতও হয়। চিন্তা নেই নিশ্চয়ই।

আসলেই কি নেই? নতুন ঢাকায় কাচেঘেরা সুউচ্চ ভবনের ভেতর আগুন লেগে স্রেফ ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষ মরেছে, এমন খবর দেখেছি আমরা। বিপদের সময় একটু বাতাসের জন্য কাচের দেওয়াল ভেঙে ফেলতে মরিয়া জীবন-যোদ্ধারা পুরো ভবনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাচের সাজ ভেঙে বেরুতে পারেননি। মনে আছে?

এরপর টক শো-তে অনেক কথাই শুনেছি। আগুন পুোন ঢাকা-নতুন ঢাকার পার্থক্যকে চেনে না, ভূমিকম্পও চেনে না। কাচেঘেরা ভালো বাসা বিপর্যয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাবে, কাচ ছিটকে যাবে চারদিক, তীব্র ছুরির মতো এসে লাগবে গলায়-বুকে-চোখে-সব খানে, এমন আশংকার কথা বলে ঝড় তুলেছেন অনেকেই। বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে কাচ ভেঙে পড়ার ঝুঁকির সাথে আলোচিত হয়েছে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়া, ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়াসহ উদ্ধারকাজে ঝামেলা তৈরি হওয়ার মতো অনেক কিছু।

Advertisement

আগুন-নিরাপদ উপাদান বা উদ্ধারকাজে কাচের মতো উপাদানের গুরুত্ব এতকাল মোটেও ছিল না। কোন ভবনে কতটুকু কাচের ব্যবহার হবে, ভবনের বাইরের উপাদান আগুন ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সক্ষম হবে, আগুন ছড়িয়ে পড়লে উদ্ধারকাজে সহায়তা করার স্পেস থাকতে হবে ইত্যাদি ভাবনা অবশ্যই দরকার। কাচের ভালো বাসা বানানোর নেশায় উন্মত্ত মানুষ। সেখানে এসব আশংকা বা ভাবনার কোনো দাম নেই।

চাকরিসূত্রে তখন দুবাই থাকি। পরিচিত এক প্রবাসী বাঙালি দুবাইয়ের ঝকঝকে তকতকে এক আবাসিক ভবন দেখিয়ে অনুরোধ করলেন, ঠিক এরকম নকশা আমি যেন তাকে করে দেই। তিনি বাংলাদেশে তার গ্রামের বাড়িতে ঠিক এই রকম ভবন তৈরি করবেন। মনে মনে ভাবছিলাম, কত কষ্ট করে ভবন নকশার আদ্যোপান্ত শিখেছিলাম! আর বাস্তবে কি না কপি-পেস্ট নকশাকার হওয়ার অনুরোধ পাই!

প্রবাসী ভাইকে বলেছিলাম, আপনি অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলেন এই বাড়ির। ভেতরের, বাইরের, নানা আঙ্গিকের ছবি। এরপর দেশে গিয়ে রাজমিস্ত্রিকে ছবি দেখাবেন। দিব্যি বানিয়ে দেবে আপনার বাড়ি।

তকতকে সেই বাড়িটা কেন এত পছন্দ হয়েছিল? কাচে মোড়া ভালো বাসা, আপাদমস্তক মোড়া কাচে আকাশের ছায়া পড়ে বলে বাড়ির বাসিন্দাদের মন বোধহয় পাখির মতো ওড়ার আনন্দ খুঁজে পায়। ইটের বাড়ির চেয়ে কাচেঘেরা বাড়ি তুলনামূলকভাবে বেশি জনপ্রিয়। বেশি নিরাপদ কি না, তা কে ভাবে?

Advertisement

আসলে বাড়ি তৈরির সময় নিরাপত্তার চেয়ে আর সবার বাড়ির চেয়ে যেন দেখতে সুন্দর হয়, বড়লোক বড়লোক জাতে ওঠা ভাব আসে, এই চাওয়াটাই ফুটে উঠতে দেখেছি। বিশ্বব্যাপী ধাতব ফ্রেমে কাচের দেওয়াল বসানোর স্টাইল জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাচের অত্মস্থ শক্তি, ইচ্ছেমতো ফ্রেম বসানোর স্বাধীনতা, কাচের সহনশীলতা আর ছোট আকারে গ্লাস-প্যানেল পরিবহনের সুবিধার কারণে। প্রখর সূর্যতাপ ছিটকে যাচ্ছে কাচের গায়ে, পথচারীদের চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখাও আনন্দের। সেই ভালো বাড়ি যখন বিপদ ডেকে আনে, তখন মনের অবস্থা কেমন হয়?

নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগমান একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আকাশছোঁয়া ভালো বাড়ির রাগ দেখেছেন কখনো?’ প্রতি বর্গ ইঞ্চি কাচ ভাঙছে আর আমি সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে আছি, এমন দৃশ্য দেখার ইচ্ছে কার আছে? কারও নেই। সব বাড়ি ভেঙে যাবে, এমন গড়পড়তা ভাবনাই বা কেন ভাবতে হবে? তবে সব কাচের বাড়ি তুলনামূলকভাবে গরম বেশি হয়, এ কথা তো সত্য। এই আশংকাও ধোপে টেকেনি। কেননা, কাচের ভালো বাসার ভেতর এসি ছেড়ে দিলেই তো আভিজাত্য বেড়ে গেলো দ্বিগুণ।

ঠান্ডা বাতাসে মাথা খোলে বেশ। তখন আয়েশ করে ভাবা যায় বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের উপায়গুলো। এখন তো গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কথা বলা বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার মোক্ষম উপায়। একদল বলছে, বিশ্ব গরম হয়ে উঠছে। আরেক দল বলছে, বিশ্ব গরম হয়ে উঠলে আমার গায়ে কাঁপুনি লাগে কেন? আর সত্যটা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে কাচেঘেরা ভবনের ভূমিকা আছে, শতকরা ৪০ ভাগ শক্তির অতিরিক্ত ব্যবহারের জন্য দায়ী এরা। দুই দলই কিন্তু কাচেঘেরা ভালো বাসায় বাস করেন। দুই দলই কিন্তু এসি ভালোবাসেন।

এবার আসি আসল প্রসঙ্গে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকাপে পড়ে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ কমে গেছে। বাংলাদেশ শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করতে পারলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আগের মতো বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারছে না। ফলে বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হচ্ছে। লোডশেডিং শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। যখন এসি চলছে না, ফ্যানও না, তখন কাচের ভালো বাসা আধুনিক ‘চুল্লি’তে পরিণত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের স্থাপত্যে মৌসুমি বাতাসের ব্যবহার বেশি বেশি করে পরিবেশবান্ধব নিজস্ব স্থাপত্য রীতি দাঁড় করানো সম্ভব ছিল। কেন হলো না তেমন?

আগেই তো বলেছি। বাংলাদেশের বেচারা স্থপতিদের মুখোমুখি হতে হয় ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আসা ক্লায়েন্টের, যার সোজা বক্তব্য থাকে, ‘ওরকম বানিয়ে দেন’। ইউরোপ-আমেরিকার জলবায়ু আর বাংলাদেশের জলবায়ুর চরিত্র যে এক নয়, পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যকে যে পরিবেশ অনুযায়ী গড়ে তুলতে হয়, সে কথা বলা এবং শোনার সময় থাকে কার? ভেতরের প্ল্যানিং যেমনই হোক, আগাগোড়া ঝকমকে কাচ দিয়ে মুড়ে দিতে পারলে যে ‘স্থাপত্য’ দাঁড়িয়ে যায়, তার ঢেঁকুর কিন্তু বেশ আওয়াজের।

বাড়ির বাইরেরটা কত সুন্দর করা যেতে পারে, এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আর শ্রম কোনোটাই দরকার পড়ে না, যদি চোখ বুজে কাচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া যায়। সানশেডের ডিজাইনও করা লাগে না। ওদিকে ক্লায়েন্টকে ডিজাইন ‘খাওয়ানো’ খুব সহজ হয়ে যায়। আর ক্লায়েন্ট খানও বটে গপগপ করে। পাতলা চামড়ার দেওয়াল জায়গা নিচ্ছে কম, ফলে বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার মতো স্পেস পাওয়া যায় বেশি। এই নতুন তরিকার স্থপতি আর ক্লায়েন্টরা টেকসই ভবন, সবুজ স্থাপত্য ইত্যাদি শব্দের প্রচলন হতে বিপদে পড়ে গেছেন।

দুই পক্ষকেই উপহার দেওয়া যেতে পারে আলেক্স উইলসনের লেখা রিথিংকিং দ্য অল-গ্লাস বিল্ডিংস বইটি। এরপরও যদি না পড়েন, তাই শুধু এই কথাগুলো উদ্ধৃত করছি বইটি থেকে, ‘ঐসব চাকচিক্যের জন্য চড়া মূল্যে দাম চোকাতে হয় পরিবেশকে: শক্তির ব্যবহার বেড়ে যায়। যতদিন পর্যন্ত নতুন চকমকে প্রযুক্তি আরও সহনশীল প্রযুক্তিক সমাধান না দিতে পারে, অনেক বিশেষজ্ঞ যেমনটি বলছেন, সেভাবে সম্মিলিতভাবে আমাদের উচিত ব্যাপক চাকচিক্যের পুরোটাই কাচে মোড়ানো ভবন ব্যবহারের সমাপ্তি ঘটানো।’

সমাপ্তি ঘটানোর দরকারি ভাবনা নিয়ে কথা বলা বাড়ানো দরকার। যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবীর সম্পদ কমে যাচ্ছে। জ্বালানি সংকট ক্রমশ চরম বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। এই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর মোক্ষম সুযোগ পাচ্ছে আমাদের চিরায়ত স্থাপত্য কৌশল। কীভাবে প্রাকৃতিক বাতাস বেশি করে ঘরে ঢুকবে ও ঘরের ভেতরকার গরম বাতাস বের করে নিয়ে যাবে বাইরে, এর পুরোনো ভাবনায় ফিরতে হবে। কীভাবে দিনের আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ভালো বাসার ভেতরটা সত্যিকারের ভালো বাসা হয়ে উঠবে, ভাবতে হবে। নিজের পায়ের ওপর ছাড়া যে দাঁড়ানো আর কোনো উপায় নেই! ঠিক তেমনি নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তি ছাড়া প্রকৃতি টিকে থাকতে দেবে না, এর লক্ষণ শুরু হয়ে গেছে আর আমরা এখনো টেরই পাচ্ছি না!

আমাদের মতো আমজনতাকে বুঝতে হবে, যতই রাজপথ দখল করি না কেন, প্রতিবাদে গলা ফাটিয়ে দেই না কেন, শক্তির মজুত কমে গেলে কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না শক্তির জোগান আগের মতো রাখা। কাজেই আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম বলে গান গাইতে পারি, কিন্তু বুঝতে হবে আগের মতো সুন্দর দিন কাটানোর সুযোগ সত্যিই কমে আসছে। টিকে থাকার জন্য কৌশল প্রস্তুত করতে হবে। এই প্রস্তুতি রাষ্ট্রীয়ভাবে তো বটেই, ব্যক্তি পর্যায়েও হতে হবে। আর যে যত দ্রুত প্রস্তুত হয়ে উঠবেন, টিকে থাকার সুযোগ তার তত বেশি।

কথা কিন্তু কাচের মতো ক্লিয়ার। ঠিক কি না, বলুন!

লেখক: কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এমএস