ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। জন্ম ১৯৫১। একজন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাণিজ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
Advertisement
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ, ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, সুইডিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা, টেকসই উন্নয়ন কমিশন, অ্যাকশন এইড, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি পরামর্শক ছিলেন।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাব নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ: এর আগের সাক্ষাৎকারগুলোয় সংকটের আশঙ্কা করেছিলেন। এখন মানুষের নাভিশ্বাস প্রায়। বাজারমূল্যে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া উদ্যোগুলো কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: গোটা বিশ্বেই সংকট চলছে। বাংলাদেশও সংকটের মধ্যে। এই সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে নতুন সংকট তৈরি করার তো কোনো মানে হয় না।
সংকট মোকাবিলা করতে দক্ষতার প্রয়োজন হয়। এই দক্ষতায় বড় ঘাটতি আছে। এখানে দুটি বিষয় সামনে আসে। আমরা সাধারণত দক্ষতা বলতে বুঝি যে, একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এসে বলে দিলো আর সমাধান হয়ে গেলো। এখানে ব্যাপারটি আসলে তা নয়।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে গেলে কিছু স্বার্থ বিঘ্নিত হবে আর বৃহৎ স্বার্থ রক্ষা পাবে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালো। এর জন্য অবশ্যই ব্যাখ্যা আছে। সরকার বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা বলছে। ভালো কথা। কিন্তু এখন তো বিশ্ববাজারে তেলের দাম সর্বনিম্ন। তাহলে এখন কেন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো?
Advertisement
বিপিসি গত কয়েক বছরে বিশাল মুনাফা করেছে। তাদের দেওয়া তথ্য মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। এই মুনাফা গেলো কোথায়? তথাকথিত উন্নয়নে সব ব্যবহার করা হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাগো নিউজ: উন্নয়ন তো জনস্বার্থেই?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সরকার সংকট মোকাবিলায় যে উদ্যোগ নিয়েছে বা উন্নয়ন করছে সেখানে জনস্বার্থ একেবারেই উপেক্ষিত। জনস্বার্থ নিয়ে সরকার আসলে খুব বেশি চিন্তা-ভাবনা করে না।
যারা নীতি গ্রহণ করছেন বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন সেখানে বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে। এ কারণে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। কেন দাম বাড়ানো হলো, তা নিয়ে সংশয় সাধারণ মানুষের মধ্যেও।
জাগো নিউজ: সরকার তো ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। পাশের দেশে তেল পাচারের আশঙ্কা আছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আন্তর্জাতিক বাজারে এখন তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণে কমেছে, তা আগেই বললাম। সুতরাং এই ব্যাখ্যা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। আর পাশের দেশে তেল পাচার হয়ে যেতে পারে আশঙ্কায় তেলের দাম বাড়ানো সত্যিই হাস্যকর। সীমান্তে নিরাপত্তা দিতে পারছে না বলে পাচার হবে, এটি তো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
জাগো নিউজ: বিশ্লেষকরা আরেকটি ব্যাখ্যা সামনে আনছেন। সরকার আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে, যার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্বালানির ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আইএমএফ এমন শর্ত দিয়েছে এমনটিও পরিষ্কার নয়। কারণ ঋণ নিয়ে এখনো তো দরকষাকষি শুরু হয়নি।
মূলত, সরকার আর্থিক সংকটে পড়েছে। সরকার এলএনজির মতো উচ্চমূল্যের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল। জ্বালানির অভ্যন্তরীণ পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। গত এক দশকে এ সক্ষমতার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ কারণে চাহিদা মেটাতে গিয়ে এলএনজি আমদানি বাড়াতে হয়েছে। যে কারণেই হোক একেবারে এত পরিমাণে জ্বালানির দাম বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
আমাদের অর্থনীতি চেইনের মতো। একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে অন্য আরও বিষয়ের ওপর প্রভাব পড়বে। আমরা এরই মধ্যে এই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। জ্বালানির সংকট বৃহৎ সংকটকে উসকে দিচ্ছে।
জাগো নিউজ: রেন্টাল-কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট নিয়ে বিতর্ক ছিল শুরু থেকেই। ডিজেলচালিত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ। আজকের সংকটের জন্য রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কতটুকু দায়ী বলে মনে করছেন?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: এই প্রকল্পগুলো এক প্রকার সাময়িক সমাধান এনে দিয়েছিল। তখন এগুলোকে সাময়িক পদক্ষেপ বলা হয়েছিল। কিন্তু এতদিন চালু রাখা হলো কেন?
আমরা অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নিতে পারিনি। জ্বালানি পরিশোধন করার বেলায় বিনিয়োগ করা হয়নি। সরকার শতভাগ বিদ্যুতায়নের ক্রেডিট নিতে মরিয়া হয়ে উঠলো। যে কারণে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেতে হলো। গ্রাহককেও এর দায় টানতে হলো। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হলো বিশাল অঙ্কের। বসিয়ে রেখে এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না।
সমন্বিত চিন্তা না করার কারণেই আজকের এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিতরণের ব্যাপারে তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যে কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়েছে এবং কোটি কোটি ভর্তুকি দিতে হয়েছে।
গোষ্ঠী স্বার্থের কারণেই জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনা। বেহিসাবি খরচ আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে জ্বালানি খাতের সত্যিকার উন্নয়ন হয়নি।
২০০৯ সালে যখন সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো, তখন অনেকেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ আসলে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। আবার অদক্ষ বললেও ভুল বলা হবে। মূলত, গোষ্ঠীস্বার্থের সুবিধার্থে জ্বালানিখাতকে ব্যবহার করা হয়েছে।
জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষকে এর মূল্য কীভাবে দিতে হবে?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: সাধারণ মানুষ এরই মধ্যে এর মূল্য দিচ্ছে। আমরা গত মে মাসে গবেষণা করে দেখেছিলাম যে, দেশে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এখন কত কোটি হয়, সেটাই দেখার বিষয়। এই সংকটের মধ্যেও প্রশ্ন জাগে যে সরকার সাধারণ মানুষকে বিবেচনায় রেখে নীতি গ্রহণ করবে কি না? সাধারণ মানুষকে মাথায় রেখে নীতি গ্রহণ করলে জ্বালানির দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই ব্যাখ্যার প্রয়োজনবোধ করতো সরকার। তা আমরা দেখিনি।
আমি মনে করি, সরকারের উচিত এখনই সার্বিক বিষয় নিয়ে মানুষকে জানানো। সংকটের ধরনটা কী, কোন পথে সমাধান হতে পারে তার ব্যাখ্যা দেওয়া। আংশিক ব্যাখ্যা দিলে হবে না। লুকোচুরি বা জোড়াতালির কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষকে বলির পাঠা বানালেই যে সমাধান হবে, তা নয়। সংকট আরও বাড়তে পারে।
জাগো নিউজ: করোনার কারণে তো সব দেশকেই ঠেকতে হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর নিদারুণ প্রভাব পড়েছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: করোনার প্রভাব সব সেক্টরে ক্ষতি ডেকে এনেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম তো এখন কম। মানুষ তো বোঝে। জোড়াতালির ব্যাখ্যা মানুষ মানবে কেন?
ডলারের সংকট সরকার দেখাচ্ছে। এটি তো জ্বালানি আমদানির জন্য নয়। ডলারের মূল্য বেড়েছে ঠিক। কিন্তু এর পেছনে তো ব্যাংকের কারসাজি এবং অব্যবস্থাপনাও দায়ী। এটি তো সরকার রোধ করতে পারতো অন্তত। সরকার কিছু ব্যক্তিকে বরাবরই সুবিধা দিয়ে আসছে, যাদের কালো ছায়া বিভিন্ন সেক্টরে পড়ছে। তারা সরকারের মধ্যে আরেকটি সরকার।
মানুষ এখন দুই ধরনের সংকটে রয়েছে। প্রথমত, বাস্তবমুখী সংকট। দ্বিতীয়ত, সঠিক তথ্য না পাওয়ার সংকট। সরকার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তাতে মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। গরমিল দেখতে পাচ্ছে। বিশ্বাস পাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক ব্যাখ্যা না পাওয়ার কারণে মানসিক সংকট বাড়ছে জনসাধারণের।
জাগো নিউজ: শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে। আপনার অভিমত কী?
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: আমি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করতে চাই না। বাংলাদেশের সংকট আর শ্রীলঙ্কার সংকট এক বিষয় নয়। তবে বাংলাদেশ কোন পথে, তা সরকারের ব্যাখ্যায় মিলবে। গোজামিলের তথ্য মানুষকে আরও হতাশ করে। মানুষ সঠিক তথ্য পেলে সঠিক সিদ্ধন্ত নিতে পারে। এতে দেশ জাতির কল্যাণ হবে। মানুষ সাশ্রয়ী হবে। সঞ্চয়ী হবে। কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্য পেলে তো মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ তার জীবন নিয়ে কাঠামো দাঁড় করাতে পারছে না। সরকারের উচিত সার্বিক বিষয়ে মানুষকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা।
এএসএস/এএসএ/জিকেএস