জাতীয়

এমন মৃত্যু দেখে উত্তরার মানুষ শোকে স্তব্ধ

‘গার্ডারটি যখন ক্রেন থেকে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে, চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন পথচারীরা। তখন বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে ঘটনাস্থলে যাই। প্রাইভেটকারের ভেতরে থাকা লোকগুলোকে বের করতে চেষ্টা করি। আমার সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন যোগ দেন। তখনো ঘটনাস্থলে পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের কেউ আসেনি। কিন্তু গার্ডারের যে ওজন, কোনোক্রমেই গাড়ি সরানো যাচ্ছিল না। আমরাও জীবিত বা মৃতদের বের করতে পারছিলাম না। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার কাজে গেলেও তারা তাৎক্ষণিক গার্ডারটি সরাতে পারেননি। তাদেরও সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এমন অবস্থা দেখে উপস্থিত সবার চোখেমুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সবাই হতাশ হয়ে যান। তখন ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।’

Advertisement

মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) সকালে উত্তরার জসিমউদদীন রোডের স্থানীয় বাসিন্দা তানভীর সোহেল এভাবেই ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার পরের পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এই রোডে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই দুর্ঘটনা আতঙ্কে ছিলেন যানবাহনচালক ও পথচারীরা। সোমবার (১৫ আগস্ট) তেমনি একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটলো। অথচ প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তার কোনো বালাই ছিল না। একদিকে বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলছে, আরেকদিকে যানবাহন চলাচল করছে। কারো যেন কোনো দায়বদ্ধতা নেই।

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বরে রোডের চশমার দোকানি আলমগীর হোসেন। গতকাল দুর্ঘটনার পরপর ঘটনাস্থলে ছুটে যান। কিন্তু তিনিও নিরুপায় ছিলেন। আলমগীর হোসেন বলেন, প্রাইভেটকারের ওপর থেকে গার্ডারটি সরানো সম্ভব ছিল না। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে শুধু মানুষের আর্তনাদ শুনছিলাম। এমন করুণ দৃশ্য আর কখনোই দেখিনি। এমন মৃত্যু দেখে উত্তরার মানুষ শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।

Advertisement

তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পে হাজারো কোটি টাকা ব্যয় করছে সরকার। কিন্তু এই প্রকল্পে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। যার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে।

জসিমউদদীন রোডে জামাল মিয়ার চায়ের দোকান। মঙ্গলবার সকালে তার দোকানে বসে এই দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী আরিফ চৌধুরী ও মো. শাহজালাল।

আলাপকালে শাহজালাল বলেন, গতকাল জসিমউদদীন রোডে গার্ডারের চাপায় যে মানুষগুলো নিহত হয়েছেন, এটা দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এটা হত্যাকাণ্ড। এর দায় বিআরটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্টদেরই নিতে হবে।

তিনি বলেন, গতকাল দুর্ঘটনার সময় হাজারো মানুষ চারদিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। উদ্ধার করার মতো কারও সক্ষমতা ছিল না। এ যেন হাশরের দিনের মতো অবস্থা হয়েছিল। এমন মৃত্যু যেন আর কারো না হয়।

Advertisement

মঙ্গলবার সকাল ৮টায় সরেজমিনে দেখা যায়, গার্ডার এবং ক্রেনটি দুর্ঘনাস্থল থেকে সরিয়ে পাশে রাখা হয়েছে। চালক বা বিআরটি প্রকল্পের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। পাশ দিয়ে আগের মতোই যান চলাচল করছে। সেখানে দুর্ঘটনার কোনো আলামত নেই। সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের কথ রয়েছে। তাই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আশপাশের সড়ক পরিস্কার করতে দেখা যায়।

সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকেল সোয়া ৪টার দিকে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে দুই শিশু, দুই নারী ও একজন পুরুষ মারা গেছেন। তবে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনি (২১) নামে নবদম্পতি গুরুতর আহত হয়েছেন। তারা উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হতাহতরা ঢাকায় বৌভাতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফিরছিলেন।

এই ঘটনায় গতকাল উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় অবহেলাজনিতভাবে ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত দুই বোনের ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় তিনি অবহেলাজনিতভাবে ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, সিজিজিসি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

তিনি বলেন, ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।

এদিকে উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সোমবার রাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, কমিটিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট অনুবিভাগ) নীলিমা আখতারকে প্রধান করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে একদিনের মধ্যে প্রাথমিক ও দুদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এমএমএ/এমএস