করোনা মহামারির কারণে দেশে দেশে ধারাবাহিক লকডাউনের ফলে স্থবির হয়ে পড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি। মহামারির কারণে ব্যাহত হয় খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্য উৎপাদন। ফলে বিশ্বের অনেক দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়ে। করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমে এলে অর্থনীতিতে ফের চাঙাভাব দেখা দেয়। তবে এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ে বিশ্ব।
Advertisement
বর্তমানে সারাবিশ্বে অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। বিশেষ করে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ডলার ও জ্বালানি তেলের দাম। বেড়েছে পরিবহন ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। এর মধ্যে আবার কিছু সুবিধাভোগী অসাধু চক্রের নৈরাজ্য তো আছেই। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) বলছে, ‘উন্নয়নের নৌকা এখন শ্রীলঙ্কার পথে’। রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি বলছে, ‘সরকার দেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়েছে’।
এই সংকট সমাধানে দুর্নীতির শ্বেতপত্র ও পাচারকারীদের তালিকা প্রকাশ এবং তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জাপার। অন্যদিকে বিএনপি চায়, সরকারের পদত্যাগ-পতন।
সম্প্রতি, খোলাবাজারে হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। বেড়েছে স্বর্ণের দামও। পাশপাশি গত ৫ আগস্ট দিনগত মধ্যরাত থেকে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। যার কারণে বাসভাড়ায় নৈরাজ্য চরমে। এ নৈরাজ্যের শিকার খোদ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা কাজী জাফর উল্ল্যাহ। সড়কের পরিস্থিতি জানতে একদিন বাসে চড়ে তিনি অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, দেখলাম তো যাত্রীদের যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে। ২০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৫০ শতাংশ। এটা তো উচিত নয়।
Advertisement
এদিকে, গত ১২ আগস্ট দলের এক অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, যখন আমরা বলেছি দেশ শ্রীলঙ্কার মতো ব্যর্থ হতে চলছে। তখন বলা হয়েছে, বিরোধীদল ষড়যন্ত্র করছে। দেশের স্বার্থে কথা বললেই সরকারের কিছু নেতা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজেন। অথচ ইউরোপ, আমেরিকা, সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া উন্নয়নের নৌকা এখন ঠিকই শ্রীলঙ্কার পথে।
তিনি বলেন, সরকারকে জ্বালানিখাতের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। দেশের মানুষ জানতে চায়, জ্বালানিখাতে প্রতি বছর কত হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে। কারা এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত? তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকার পাচারকারীদের তথ্য প্রকাশ না করে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দুর্নীতিবাজ ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে অপরাধীদের পক্ষ নিচ্ছে সরকার- দাবি করেন জিএম কাদের।
অন্যদিকে বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করে দেশের এই সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করে পদত্যাগের দাবি তুলেছে।
Advertisement
তবে এ অবস্থায় সরকারের পতন বা পদত্যাগে কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বা এই মুহূর্তে হাল ধরে সংকট সমাধান করবেন এমন কে আছেন? এসব প্রশ্নের উত্তরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ বলছেন, এই সংকটে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। অনেকেই আবার বলছেন, বর্তমান সরকারের পতনে সংকটের সমাধান না হলেও সুশাসন ফিরবে, দুর্নীতি আর অর্থপাচার বন্ধ হবে। তাতে সংকট উত্তরণের পথ সুগম হবে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির এই অলীক অভিযোগ গতানুগতিক রাজনৈতিক বক্তব্য। চলমান বিশ্ব বাস্তবতার কারণে আমাদেরও কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। আমাদের দেশ সংকটে পড়েনি। বরং সংকটে যেন না পড়ে সেজন্য বহুমুখী পরিকল্পনা, কৃচ্ছ্রসাধন, মুদ্রা সংকোচন নীতি, সরকারে ব্যয় কমানো, আমদানি হ্রাস, রপ্তানি বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধিসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসব বাস্তবমুখী পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী করবে, কিন্তু দলের চেয়ে দেশ বড়।
‘বিগত দশকে বিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক, দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ বহুদূর এগিয়েছে। এখন বিশ্বমন্দার মধ্যেও আমাদের দেশ অন্যদের তুলনায় অনেক ভালো আছে। এতদিন শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের যতটা প্রয়োজন ছিল, আজ ও আগামীর বিশ্ব সংকটে দেশ ভালো রাখতে তাকে আরও বেশি প্রয়োজন। শেখ হাসিনার বিকল্প কেবল তিনিই।’
আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। তবে, বিএনপির দাবি অনুযায়ী, এই মুহুর্তে সরকার পদত্যাগ করলে কে ধরবে হাল, যিনি এই সংকট উত্তরণ করতে পারবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ রুমিন ফারহানা জাগো নিউজকে বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে সঠিক নেতৃত্ব আসার আগ পর্যন্ত ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে কেউ দায়িত্ব পালন করবেন। যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের আছে। অতীতে আমরা এমনটা দেখেছি।
তিনি বলেন, স্থান কখনো খালি থাকে না। সময় নেতা তৈরি করে। সময়ের প্রয়োজনে নেতা তৈরি হয়। যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, তখন যেমন আমরা দেখেছিলাম নেতা (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) তৈরি হয়েছেন। তার মৃত্যুর পরও কিন্তু জায়গা খালি থাকেনি। এমন নেতা আমরা পেয়েছি, যিনি (জিয়াউর রহমান) বাংলাদেশকে কয়েকশ বছর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। আজ যে অর্থনীতির ভিত্তি সেটা তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। সময়ের প্রয়োজনে খালেদা জিয়াও দীর্ঘ ১০ বছর রাজপথে আন্দোলন করে নেতা হয়ে ওঠেন। এখন বিএনপির অবিসংবাদিত নেতা তারেক রহমান। কিন্তু এই সরকারের পতনটা এই মুহূর্তে দরকার। কারণ সরকার দেশকে শ্রীলঙ্কার দিকে নিয়ে গেছে। অথচ তথ্য গোপন করছে।
রুমিন ফারহানা বলেন, শ্রীলঙ্কার এ অবস্থা হওয়ার আগে লক্ষণগুলো কী ছিল? রিজার্ভে ঘাটতি, রিজার্ভ কমে আসছে, বিদ্যুৎ সমস্যা, জ্বালানি সমস্যা, পেট্রলপাম্পে মানুষ গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো, পেট্রল-ডিজেল-অকটেন নেই। বাংলাদেশও সেদিকে গেছে। গত ৫ আগস্ট হঠাৎ করে রাত ১২টার পর জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাব কিন্তু একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দুটো মাত্র দেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অবস্থা সবাই জানে। এই সরকারের উচিত শিগগির পদত্যাগ করা। সময় বলবে, দায়িত্বভার কে নেবে- যোগ করেন রুমিন ফারহানা।
এসব বিষয়ে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি সাধারণ মানুষের সংকট নিয়ে কোনো আন্দোলন সাম্প্রতিককালে করেছে- আমি দেখিনি। তারা সব কথায়ই সরকার পতনের কথা বলে। সরকার বদলের স্লোগানের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীরা থাকবেন, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই আন্দোলনের যদি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হয়, তাহলে জনগণের ইস্যুর কথা বলতে হবে। সম্প্রতি আমরা দেখলাম, নয়াপল্টনে তারা যে সমাবেশ করেছে, সেখানে জনগণ সম্পর্কিত কথা বলেছে। তারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং বাসভাড়া বৃদ্ধির কথা বলেছে অর্থাৎ সংকটে যে মানুষ ভুগছে, সে কথা বলেছে। এটি খুব ভালো দিক। যে দল ক্ষমতায় যেতে চায়, সে দল জনগণের সমস্যার বিষয়ে ভাবছে, এটি খুবই ইতিবাচক। কিন্তু আপনি এই কথাগুলো বলেই আবার বলছেন, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। ভালো, এটি আপনার দাবি থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- সরকার পদত্যাগ করে কাল আপনি ক্ষমতায় গেলে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? আমি তো সে প্রশ্নের জবাব পাই না।
তিনি বলেন, বিএনপি কি এই কথা বলে- কাল আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে ডলারের দাম আমরা ৮০-৯০ টাকার মধ্যে নিয়ে আসবো? আমি বিএনপির কাছে জানতে চাই, আজ সরকার পতন হলো আর আপনি ক্ষমতায় গেলেন, তাহলে কি আপনি জ্বালানি তেলের যে বিশ্বব্যাপী সংকট, সে সংকট থেকে আমাদের স্বস্তির জায়গায় নিয়ে আসতে পারবেন? অকটেন, ডিজেল ও পেট্রলের যে দাম বেড়েছে, সেটা কমিয়ে আনতে পারবেন? এই প্রশ্নগুলোর জবাব নেই। ফলে সরকার পতনের দাবিটা হচ্ছে বিএনপির দলীয় আন্দোলন। জনগণ সম্পর্কিত যে দাবিগুলো নিয়ে তারা সরকার পতন ঘটাতে চায়, এসব প্রশ্নের জবাব না দেওয়া পর্যন্ত জনগণ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে না।
মনজুরুল আহসান বুলবুল আরও বলেন, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বিএনপির আন্দোলনে আমিও সম্পৃক্ত হতে চাই। কিন্তু আমাকে বলেন, কাল যদি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, আপনি ক্ষমতায় গেলে ডলার, জ্বালানি তেল, দ্রব্যমূল্য ও পরিবহন নিয়ে আপনি কী করবেন? এগুলোর তুলনামূলক চিত্র আপনারা দেন, তাহলে সেটি আমরা সরকারের দেওয়া চিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবো। যদি আপনার প্রস্তাবনা, সরকারের দেওয়া চিত্রের চেয়ে ভালো হয়, তাহলে নিশ্চয়ই জনগণ আপনার সঙ্গে যাবে। আর যদি সেটি আপনারা না করতে পারেন, তাহলে সরকার পরিবর্তনটা হচ্ছে আপনার ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্ছা। মানুষ মনে করবে জনগণের সমস্যা নিয়ে আপনারা আন্দোলনের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার লিপ্সা মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। মানুষ এই ফাঁকাটা বুঝতে পারে।
সংকটের বিকল্প চিত্র দিতে হবে। যেখানে মানুষ আপনার ওপর আস্থা রাখবে যে, আপনি ক্ষমতায় গেলে এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু তাদের (বিএনপি) বক্তৃতার মধ্যে সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত আমি দেখি না। তাদের পরিকল্পনার কোনো কিছু দেখি না। তারা শুধু একটি কথা বলে, সরকার বদল, সরকার বদল। এটি তাদের দলীয় কর্মসূচি। এতে তাদের দলের নেতাকর্মীরা সঙ্গে থাকবেন। সাধারণ মানুষ তাদের এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে বলে আমি মনে করি না- যোগ করেন মনজুরুল আহসান বুলবুল।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সংকট থেকে উত্তরণ না করতে পারলেও এটা গুড ম্যানেজমেন্ট হবে। কারণ এখন দেশের টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। যখন সারাবিশ্বে তেলের দাম কমেছে তখন বাংলাদেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সুতরাং, এটা স্পষ্ট বাংলাদেশে লুটপাট হচ্ছে। গত ১০ বছরে এই সরকারের আমলে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। কুইক রেন্টাল; যেটা দুই বছরের জন্য আনা হলো, সেটা ১৬ বছর ধরে চলছে। এসব অনিয়ম যদি দূর হয় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে বাংলাদেশে সংকট দূরীভূত হবে।
এসইউজে/কেএসআর/এএসএ/এমএস