জাতীয়

ঢাকায় দুর্ঘটনায় একদিনেই ঝরলো ১২ প্রাণ

রাজধানীতে পৃথক তিনটি দুর্ঘটনায় একদিনে প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। সোমবার (১৫ আগস্ট) এসব দুর্ঘটনা ঘটে। দুপুরে পুরান ঢাকার চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউনে লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে ছয়জন মারা গেছেন। বিকেলে উত্তরায় ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত হয়েছেন।

Advertisement

রাত ৮টার দিকে গুলিস্তানে ক্রেন থেকে রড পড়ে পাঁচজন গুরুতর আহত হয়েছেন। সর্বশেষ রাত সোয়া ১১টার দিকে বনানীতে বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছেন মোটরসাইকেল আরোহী এক যুবক।

চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডসোমবার দুপুর ১২টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের দেবীদাসলেন এলাকায় প্লাস্টিক কারখানা ও গোডাউনে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টার চেষ্টায় দুপুর ২টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ওই ভবন থেকে ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

মৃতরা হলেন- হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার রাকেশ সরকারের ছেলে স্বপন সরকার (১৯), শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার দক্ষিণ বড় কাসমা এলাকার আবুল কালাম সরদারের ছেলে ওসমান (২৫), বরিশালের মুলাদী উপজেলার টুমচর এলাকার মৃত আলম সরদারের ছেলে বিল্লাল (৩৫), একই বিভাগের হিজলা উপজেলার শংকরপাশা এলাকার মো. মোস্তফা ছেলে মোতালেব (১৬)।

Advertisement

আরও পড়ুন: ওমান যাওয়া হলো না স্বপনের

মৃত অন্য দুজন হলেন- কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার তিতচর এলাকার মিজানের ছেলে মো. শরীফ (১৬) ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ আকাল বরিশ এলাকার সাত্তার হিলালুর ছেলে রুবেল (২৮)।

বিকেল সাড়ে ৫টার পর মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে নেওয়া হয়। এসময় হাসপাতালের বাইরে নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। প্রত্যেকেই তাদের স্বজনের ছবি নিয়ে বারবার ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ছুটতে থাকেন।

উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনারাজধানীর উত্তরায় ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে প্রাইভেটকারের পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- রুবেল, ঝরণা, ফাহিমা, জান্নাত ও জাকারিয়া। তাদের মরদেহ বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দুজন।

Advertisement

জানা গেছে, ঢাকার সঙ্গে গাজীপুরের সড়ক যোগাযোগ আধুনিক করতে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) নির্মাণকাজ চলছে। ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট’ শীর্ষক এ প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত হন।

সোমবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হতাহতরা ঢাকায় একটি বৌভাতের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফিরছিলেন।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গাড়িতে মোট সাতজন যাত্রী ছিলেন। এরমধ্যে দুই শিশু, দুই নারী ও একজন পুরুষ মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনি (২১) নামে নবদম্পতিও আহত হয়েছেন। তাদেরকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা এখন শঙ্কামুক্ত।

স্বজনরা জানান, ফাহিমা হলেন নববধূ রিয়া মনির মা। আর ঝরণা হলেন তার খালা। রুবেল সম্পর্কে ফাহিমা-ঝরণার বেয়াই। জান্নাত ও জাকারিয়া ঝরণার সন্তান। ফাহিমা-ঝরণাদের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুরে। আর রুবেলের বাড়ি মেহেরপুরে।

নিহতদের স্বজনরা বলছেন, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড। তারা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা করবেন।

সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে সোমবার রাতে কথা হয় নুরুজ্জামান ঢালী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি নিহত রুবেল মিয়ার শ্যালক। নুরুজ্জামান বলেন, ‘গাড়ি চলাচল করছে, তার মধ্যেই ক্রেন দিয়ে গার্ডার তোলা হচ্ছিল। ক্রেন উল্টে গেছে, প্রাইভেটকারের ওপর পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যস্ত রাস্তায় ১২০ টন ওজনের গার্ডার তোলা হচ্ছিল। অথচ সেখানে কোনো নিরাপত্তা নেই। গাড়ি চলাচলও বন্ধ করা হয়নি। নিরাপত্তা থাকলে বা গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখলে আমরা স্বজন হারাতাম না। এটা দুর্ঘটনা হতে পারে না, স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড।’

নুরুজ্জামান ঢালী আরও বলেন, ‘আমাদের সবার একই দাবি, বিচার চাই। সঠিক তদন্ত করে যাতে বিচার নিশ্চিত করা হয়, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই। আমরা এটা নিয়ে মামলা করবো। ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা করবো। আইনি প্রক্রিয়া জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

আরও পড়ুন: ‘পুলিশ ভাই লাশগুলো রাখেন, মোবাইল-গহনা দিয়ে দেন’

এদিকে, দুর্ঘটনার সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সোমবার বিকেল সোয়া ৪টার দিকে ক্রেন দিয়ে ১২০ টন ওজনের একটি গার্ডার সরানোর কাজ চলছিল। এসময় সড়ক দিয়ে যানবাহন চলছিল। গার্ডার সরানোর আগে অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের সামনে ছিল দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেটকারটি (ঢাকা মেট্রো-গ ২২-৬০০৮)।

হঠাৎ প্রায় ৯ থেকে ১০ ফুট ওপর থেকে ছিটকে গাড়ির ওপর পড়ে গার্ডারটি। ওই সময় কিংবা তার আগে বিআরটি প্রকল্পের দায়িত্বরত কাউকে সড়ক বন্ধ করে যান চলাচল বন্ধ করতে দেখা যায়নি।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তিনিই ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন নাকি অন্য কেউ চালাচ্ছিলেন, সেই প্রশ্নের জবাব আপাতত নেই। চালককে ধরা গেলেই সব প্রশ্নের জবাব মিলবে।’

ওসি বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত পাঁচজনের মরদেহ ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে বুঝে পেয়েছি। আহত দুজনকে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ক্রেনের চালককে আটকের পরই সব প্রশ্নের জট খুলবে।’

ঢাকা বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিআরটি রাস্তা বন্ধ করতে পারে না। এ বিষয়ে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে প্রকল্পের চুক্তি রয়েছে। এর বাইরে আপাতত কিছু বলতে পারবো না।’

এদিকে, উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সোমবার রাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী জাগো নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, কমিটিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর্ট অনুবিভাগ) নীলিমা আখতারকে প্রধান করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে একদিনের মধ্যে প্রাথমিক ও দুদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বনানীতে ট্রাকের ধাক্কায় বাইকবিডি’র হোস্ট নিহতরাজধানীর বনানী ফুটওভার ব্রিজের নিচে ট্রাকের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। তার নাম জামিল আহমেদ শুভ (২৪)। তিনি ফেসবুকভিত্তিক বাইক রিভিউ ‘বাইকবিডি’র হোস্ট। সোমবার রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে বনানী ফুটওভার ব্রিজের নিচে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন নিহত শুভর ৪-৫ জন বন্ধু। তাদের মধ্যে চিন্ময় নামে একজন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুভ আমাদের খুব কাছের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করেছি। বাইকের প্রতি শুভর প্রচুর ঝোঁক ছিল। এ কারণে শুভ গ্রাজুয়েশন শেষ করে ফেসবুকভিত্তিক মোটরসাইকেল রিভিউ বাইকবিডির হোস্ট ছিলেন।’

ট্রাকের ধাক্কায় বাইকবিডির হোস্ট নিহত/ছবি: জাগো নিউজ

বনানী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এম শামসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসে যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহ ও নিহতের মোটরসাইকেল থানায় নেওয়া হয়েছে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনানী থেকে মহাখালীগামী একটি সিএনজি নিহতের মোটরসাইকেলকে ধাক্কায় দেয়। এরপর একটি বড় ট্রাক মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিলে শুভ রাস্তায় ছিটকে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। দ্রুত ঘাতক ট্রাকটি পালিয়ে যায়।

গুলিস্তানে ক্রেন থেকে রড পড়ে আহত ৫রাজধানীর গুলিস্তানে ক্রেন থেকে পড়া রডের আঘাতে পাঁচজন আহত হয়েছেন। সোমবার রাত ৮টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। বর্তমানে তারা চিকিৎসাধীন

ক্রেন থেকে পড়া রডের আঘাতে গুরুতর আহত দুজন/ছবি: জাগো নিউজ

আহতরা হলেন- মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন (৪০) ও মোহাম্মদ জাকির হোসেন (৩৫), রেজাউল করিম (৩৫) জাহাঙ্গীর হোসেন (৪০)ও সবুজ মিয়া (৪৫)।

শাহাবুদ্দিন ওই এলাকায় ব্যবসা করেন। জাকির হোসেন ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি করেন। বাকি তিনজনই ফুটপাতে ব্যবসায়ী।

আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যান নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, গুলিস্তান হলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ হল মার্কেটের ওপরে থাকা ক্রেন থেকে রডের টুকরো নিচে পড়ে। ওই রডের আঘাতে তারা গুরুতর আহত হয়েছেন।

এএএইচ