জাতীয়

‘মানুষের জীবন এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হতে পারে না’

অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ পরিচিত নাম, দেশ এবং দেশের বাইরে।রাজধানীতে নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে হতাহতের ঘটনা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।জাগো নিউজ: ফের গার্ডারের চাপায় মানুষ মরলো। নির্মাণ প্রকল্পে জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ফের প্রশ্ন দেখা দিলো। দিনের আলোয় রাজধানীতে এই দুর্ঘটনা গা শিউরে ওঠার মতো নয় কি?অধ্যাপক ড. সামছুল হক: আসলে এমন ঘটনার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ঘটনা এটি। নির্মাণ প্রকল্পে নিরাপত্তার ঝুঁকি ও অব্যবস্থাপনার কারণে এমন মৃত্যু অত্যন্ত ব্যথাতুর আমার কাছে। মানুষের জীবন এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হতে পারে না!জাগো নিউজ: এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটলো। নিরাপত্তার এই অব্যস্থাপনা কি পরম্পরায় চলছে?ড. সামছুল হক: এই অহেতুক দুর্ঘটনা একবারই না। বিআরটি প্রকল্পে এ পর্যন্ত তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটলো। তার মানে আমরা আগের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেই না। শিক্ষা নেই না বলেই একের পর এক ঘটনা ঘটছে। এই ঘটনাগুলো থেকে অনেক বিশ্লেষণের খোরাক আছে।জাগো নিউজ: যেমন...ড. সামছুল হক: জবাবদিহি কোথাও নেই, মানুষ মরলেও নেই। একটি অ্যাকটিভ সড়কের ওপর এমন প্রকল্প, অথচ নিরাপত্তার ঘাটতি সর্বত্রই। এর আগেও গার্ডার পড়েছে। এর আগেও মানুষ মারা গেছে। তার মানে, ঝুঁকিমুক্ত থাকার জন্য যে ধরনের যন্ত্র বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা, তা নেই। বিন্দুমাত্র কিছু নেই। এটি জানান দেয় যে আমরা কতকিছু কম্প্রোমাইজ করে উন্নয়ন করে চলছি।আমার কাছে সবচেয়ে কষ্ট লাগে এ কারণে যে, একই ঘটনা বারবার ঘটছে কিন্তু কাউকে দায়ী করা হয় না।এমন একটি বিআরটি প্রকল্প সর্বোচ্চ ৯ থেকে ১০ মাসে শেষ হওয়ার কথা। এ কারণেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় দাওয়ায় হিসেবে গ্রহণ করে থাকে এমন প্রকল্পকে। আর আমাদের মতো অনাহারি লোকের হাতে পড়ায় আমরা খরচের বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছি, সময়ক্ষেপণের বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেছি। এখন মৃত্যুর বিশ্বরেকর্ড করে চলছি।বিআরটি হচ্ছে একটি মৌলিক প্রজেক্ট। এমন একটি প্রজক্টেই যদি এত এত বিশ্বরেকর্ড গড়তে পারি, তাহলে সেখান থেকে অনেক কিছুই আমাদের জানান দিচ্ছে।জাগো নিউজ: কী জানান দিচ্ছে এমন ঘটনা?ড. সামছুল হক: মূলত আমাদের সক্ষমতা নেই বড় উন্নয়নের। সক্ষমতা থাকলেও আমরা দায়সারা গোছের কাজে অভ্যস্ত। জবাবদিহি নেই আমাদের। মানুষ মরলেও আমাদের ঘুম ভাঙে না। এ ঘটনা আমাদের নির্লিপ্ততা জানান দিচ্ছে, উদাসীনতাকে জানান দিচ্ছে।জাগো নিউজ: বিশেষত কাকে দায়ী করা যায় এমন ঘটনায়?ড. সামছুল হক: নির্মাণকাজের কতগুলো প্রটোকল আছে। একটি চলমান সড়কে যদি নির্মাণকাজ হয় তাহলে ঝুঁকিটা আরও বেশি। সাধারণত গার্ডার ওঠানোর কাজটি বেশিক্ষণ হয় না। আয়োজনের সময় বেশি। গার্ডার ওঠানোর সময় সব রাস্তা বন্ধ করে দিলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।আমরা দায় নেই না বলেই ক্যাজুয়ালি কাজটা করে ফেলছি। এখানে বহুমুখী দায় আছে। প্রথমত, ঠিকাদার হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী। ঠিকাদারকে সুপারভিশন করে থাকে আরেকটি পক্ষ। এই দুই পক্ষের দায় বেশি। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও দায় বর্তায়। কারণ সড়কের ওপর কাজ চলছে। কেউ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে হয় সেখানে সহায়তা করে ঝুঁকিমুক্ত রাখবে না হয় বাধা দেবে।আজ ছুটির দিনে কাজ হচ্ছে আর গার্ডারের চাপায় মানুষ মরলো, তা কোনো মানুষই মানতে পারবে না। হয় রাস্তা বন্ধ করতে পারতো, না হয় বেশি পরিমাণে জায়গা নিয়ে কাজটি করতে পারতো। সড়কের ওপর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ পুলিশ কোনোভাবেই বরদাশত করার কথা নয়।দায় আমাদের নগরপিতাদেরও। সড়কে হচ্ছে কী? ড্রেন কাটছে রোজ, ঢাকনা খোলা, সড়ক কাটছে মন চাইলেই। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয় না। এগুলো তো আসলে সংস্কৃতির ব্যাপার। একটি টেন্ডার দেওয়া মানেই বহুপক্ষের উপার্জনের হাত বড় করা। নীতি বা বিধান প্রয়োগের কোনো বালাই নেই।জাগো নিউজ: এর জন্য সুশাসনও জরুরি?ড. সামছুল হক: অবশ্যই। সুশাসনের ঘাটতির জন্যই এসব ঘটছে। ঠিকাদারের গাফিলতি থাকতে পারে, প্রকৌশলীর থাকতে পারে। কিন্তু সরকারের গাফিলতি থাকবে কেন? মন্ত্রণালয়ের কাজটা কী? জবাবদিহি নিশ্চিত করা তো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।রাজধানীর মধ্যে একটি ব্যস্ততম সড়কে নির্মাণকাজের জন্য কি কি শর্ত ছিল, তার দায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ এড়াতে পারে না। ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে মন্ত্রণালয় জবাব নেবে। মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে প্ল্যানিং কমিশন জবাব নেবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটি জবাব নেবে প্ল্যানিং কমশিনের কাছ থেকে। এটি তো চেইনের মতো।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব প্রকল্পে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সুবিধাটা নিয়ে নিচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যখন এমন সুবিধা পেয়ে যায়, তখন তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। সবাই সুবিধাভোগী। মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, স্থায়ী কমিটি সবাই সুবিধা পায়।দায়হীন উন্নয়নের সংস্কৃতিতে মানুষ মরলে কিছুই যায়-আসে না। আগে একটি পক্ষ আরেকটি পক্ষকে জবাবদিহির প্রশ্নে ভয় পেত। এখন আর সে ভয় নেই। আগেই সুবিধা দিয়ে সে ভয় দূর করেছে। সবাই এখন এক সারিতে। এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে এভাবে মানুষ মরবেই। সুশাসনের অভাব থাকলে ব্যর্থতা সর্বত্রই দেখা দেয়।জাগো নিউজ: কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এমন চর্চা?ড. সামছুল হক: এখানে উন্নয়ন কার্যক্রম একেবারেই এলোমেলো। বিলাসী উন্নয়নে মানুষের জীবন তুচ্ছ। এমন উন্নয়নে অনেক ফ্যাট (চর্বি) থাকে। বড় মাপের প্রজেক্টগুলোতে ফ্যাট আরও বেশি। এই অতিরিক্ত খরচগুলো তো কাউকে না কাউকে সুবিধা দিচ্ছে। গাড়ি পাচ্ছে, তেল পাচ্ছে ফ্রি। এই সুবিধা নিয়ে তো অন্যকে জবাবদিহির আওতায় আনা যায় না।বিলাসী উন্নয়নের সুবিধা অনেকেই পাচ্ছে বলে সব নীতি-নৈতিকতা উধাও হয়ে গেছে। কোনো নজরদারি নেই, রক্ষণাবেক্ষণ নেই, চাপ প্রয়োগের ব্যাপার নেই, ঝুঁকিমুক্ত নির্মাণসামগ্রী নেই। উন্নয়ন আর উন্নয়নের নেশায় আমরা উন্মাদ হয়ে গেছি। খরচ বাড়ানো, সময় বাড়ানো আর মৃত্যু বাড়ানো এসব উন্নয়ন আসলে জনকল্যাণে কাজে আসে না।এএসএস/এমএইচআর/এএএইচ

Advertisement