মতামত

স্বস্তি ফিরুক জনজীবনে

আগস্ট বাংলাদেশের মানুষের জন্য শোকের মাস। ১৫ আগস্ট শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই শোকের দিন। একটি রাষ্ট্রের স্থপতি ও রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার মতো নির্মমতা গোটা বিশ্বেই বিরল। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার স্বজন, এমনকি শিশু রাসেলকেও হত্যা করেছিল।

Advertisement

আসলে ঘাতকরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কোনো উত্তরসূরি যেন বেঁচে না থাকে। কিন্তু দেশের বাইরে ছিলেন বলে, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নাগাল পায় ঘাতকের বুলেট। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বেঁচেছিলেন। ঘাতকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিলেও অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই শেষ করে যেতে পারেননি। শেখ হাসিনা তার পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আজ অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। আমাদের আফসোস, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ আজ যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, আরও অনেক আগেই হয়তো আমরা সেখানে চলে যেতে পারতাম।

শেখ হাসিনা যেমন তার পিতার স্বপ্ন পূরণের লড়াই করছেন। ঘাতকরাও কিন্তু তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল। বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছিল এই আগস্টেই।

Advertisement

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ঘাতকরা গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল। দলীয় নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে পারলেও আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছিল ওই হামলায়। তাই আগস্ট মানেই আমাদের শোক, আগস্ট মানেই বেদনা। এ লড়াই আসলে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের নয়, এ লড়াই আদর্শের লড়াই। বাংলাদেশের সাথে বাংলাদেশ বিরোধীদের লড়াই, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির লড়াই, উন্নয়নের সাথে অস্থিতিশীলতার লড়াই।

শোকের চাদরে ঢেকে আবার এসেছে আগস্ট। তবে এবারের আগস্টটি একটু অন্যরকম। শোকের সাথে মিশে গেছে অস্থিরতা, আতঙ্ক আর হাহাকার। করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এ বছর চাপ তৈরি হয়েছিল। সে চাপ সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির প্রবলতর চাপ সৃষ্টি করে। সে চাপ থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও।

রিজার্ভ কমে যাওয়া, ডলারের বাজারে অস্থিরতায় অর্থনীতিতেও একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। এই যখন অবস্থা, তখন গত ৫ আগস্ট মধ্যরাতে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি যেন বাজারের আগুনে ঘি ঢালে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, বিপিসির টানা লোকসান এবং পাচার ঠেকানোর যুক্তিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।

সরকার স্বীকার না করলেও অনেকে বলছেন, আইএমএফ’র ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণ করতেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার আসলে এই খাতে শূন্য ভর্তুকির দিকে আগাচ্ছে। জ্বালানি তেলে দাম বাড়ানোর প্রভাব সবখাতেই পড়ে। পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে। এমনিতেই আকাশে উঠে থাকা দ্রব্যমূল্য এখন উড়ছে।

Advertisement

সমস্যা হলো, সরকার নতুন বাসভাড়া ঠিক করলেও বাসমালিকরা আদায় করছেন তারচেয়েও বেশি। জ্বালানির বাড়তি দামের কারণে যে সবজির দাম কেজিতে এক টাকা বাড়ার কথা, সেটা বাড়ছে ২০ টাকা। চাল, ডিম, মুরগিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে অন্য পণ্যের দাম যতটা বাড়ার কথা, বাড়ছে তারচেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে না। তাই তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা।

এই সময়ে সরকারের উচিত সহানুভূতি নিয়ে জনগণের পাশে থাকা। জ্বালানি তেলের দাম কেন বাড়াতেই হলো, তার যৌক্তিক এবং মমতা মাখানো ব্যাখ্যা দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী নিজেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো মন্ত্রীরা একেকজন একেরকম কথা বলে পরিস্থিতি আরও হাস্যকর করে তুলছেন।

মন্ত্রীদের কথায় যেন সাধারণ মানুষের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির যে চাপ তাতে কেউই ভালো নেই। সবাই নিজ নিজ উপায়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন যখন বলেন, অন্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি। তখন আমরা কষ্ট পাই। আমরা বুঝি, সাধারণ মানুষের হাহাকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্পর্শ করছে না অথবা তিনি বাস্তবতা ভুলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

এর আগে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে।’ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এম মান্নান বলেছেন, ‘এখনো কেউ জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মারা যায়নি, আশা করি মরবেও না।’ মন্ত্রীদের এই অসংবেদনশীল কথাবার্তা মানুষের বেদনাকে আরও বাড়াচ্ছে। সমস্যা যতটা জটিল, মানুষের বেদনা তারচেয়ে বেশি হয়ে যাচ্ছে।

সবমিলিয়ে দেশে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। সবাই সারাক্ষণ জানতে চাইছে, দেশে কী হচ্ছে? সবার মধ্যেই আতঙ্ক ভর করেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তারপর থেকে কমছে শেয়ারবাজারের সূচক। মানুষের এই আতঙ্কের সুযোগে চলছে নানা অপপ্রচারও। বাংলাদেশ কবে শ্রীলঙ্কা হবে, তার অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। আসল সমস্যটা হলো, উন্নয়নের গল্প শোনাতে শোনাতে সরকার মানুষের প্রত্যাশা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই অল্প একটু এদিক সেদিক হলেই হাহাকার পড়ে যায়।

একসময় দেশে ১০-১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। এখন ৪-৫ ঘণ্টার পরিকল্পিত লোডশেডিংয়েও আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাই। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল এক বিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকারের আমলে সেটা উঠেছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। সেটা যখন ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটু নিচে নামে, আমরা বলি দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে। অথচ শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ মাত্র ২ বিলিয়ন ডলার। এই সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত, সংকটের প্রকৃত চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরা। কোনো আশার বেলুন ফুলানো নয়। কেন রিজার্ভ কমছে, কীভাবে বাড়ানো সম্ভব, কেন জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতেই হলো, কেন সরকারকে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে, অর্থনীতর বাস্তব সংকট কোথায়- এই বিষয়গুলোতে সরকারের পরিষ্কার ও বিশ্বাসযোগ্য বক্তব্য দরকার।

তথ্যের ঘাটতি থাকলে সেখানে গুজব আর অপপ্রচারের ডালপালা মেলে। আর আতঙ্ক হলো সংক্রামক। অর্থনীতির সূচকের চেয়ে বাস্তবে আতঙ্ক অনেক বেশি। এই জায়গায় সরকারের আরও বেশি দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল হতে হবে। বাজারে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার বিষয়টি কঠোর হাতে দমন করতে হবে। বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। মানুষকে দরদ দিয়ে বোঝাতে হবে পরিস্থিতির বাস্তবতা।ডলারের বাজারে অস্থিরতা, অর্থনীতির চাপ, নিত্যপণ্যের বাজারের পাগলা ঘোড়া যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের জীবনযাপনকে যতটা সম্ভব সহনশীল রাখতে হবে। আগস্ট যেন শোকের সাথে স্বস্তিও আনে মানুষের জীবনে।

১৩ আগস্ট, ২০২২

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস