হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি মুসলিম আওয়ামী লীগ এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর দূরদর্শিতার কারণেই বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তান বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে খুব অল্পসময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিল।
Advertisement
পাকিস্তান সরকার কখনই বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেনি। পূর্ব পাকিস্তানের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলাদেশে জনপ্রিয় ছিলেন ঠিক তেমনিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে অপ্রিয় ছিলেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটি ধারণা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর কারণেই পূর্ব পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পাহাড় সমান ব্যক্তিত্ব এবং দূরদর্শীতার কাছে পাকিস্তানি সরকার বারবার হেরে গেছে। বিভিন্ন সময়ে হত্যার পরিকল্পনা করেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের স্বৈরশাসকরা তাঁকে হত্যা করার সাহস দেখায়নি।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু এতটাই জড়িয়ে ছিলেন যে তাঁর নেতৃত্বেই বাংলার মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এই বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট ছিল যে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ একে অপরের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর এই কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানের দোসর বাংলাদেশের কিছু রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার জন্য স্বাধীনতার পরে তিনি দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং রাজনীতিকে সুসংগঠিত করবার ক্ষেত্রে যে যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা নিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য অত্যন্ত চমৎকার একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু যার মূল ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
Advertisement
এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন চমৎকার একটি সংবিধান প্রণয়ন করা ছিল সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জন্য একটি বিস্ময়কর বিষয়। বঙ্গবন্ধু যখন সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, ঠিক তখনই আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি অংশ খুব কৌশলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর দূরত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৭০ সালের পর থেকে তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে উঠেছিলেন। তাজউদ্দিনের সাথে ছিল অন্যান্য জাতীয় নেতা। খন্দকার মোস্তাক সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে ভুল বুঝিয়ে তাজউদ্দিন আহমদের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর একটি অংশ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছিল।
তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জনগণ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তাদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাক ডাকা ভোরে এই ধরনের একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হতে হবে। ফলে দেশের জনগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে বিধায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ তেমন দানা বেঁধে ওঠেনি। কিছু মানুষ প্রতিবাদ করলেও বন্দুকের নলের সামনে হয়ত অনেকেই সেদিন প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর লাশ থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করেছিল সেই দিন।
অন্যদিকে জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখিয়ে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে তাদেরকে গ্রেফতার করে কারাঅন্তরীণ রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে মেজর জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ফলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি অংশ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে। তখনই সেনাবাহিনীর যে অংশ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তারা কারান্তরীণ থাকে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে এই ভেবে যে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে যদি এই নেতাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসে তাহলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হবে এবং দেশে পাকিস্তানী দোসরদের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা দুরূহ হয়ে পড়বে।
Advertisement
১৫ আগস্টের সেই কাল রাত্রে হত্যাকারীরা ৮ বছরের শিশু রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুর সকল আত্মীয়দের হত্যার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে বঙ্গবন্ধুর কোন রক্ত যেন বাংলার মাটিতে না থাকে। কারণ তাদের মধ্যে এক ধরনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বঙ্গবন্ধুর রক্ত যাদের শরীরে বইছে তারা যদি বাংলাদেশের মাটিতে এসে জনগণের সামনে দাঁড়ায় তাহলে বাংলাদেশের জনগণ তাদের উপর আস্থা রাখবে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে "ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপ্রপোজেস"। তাই সেদিন ঈশ্বরের কৃপায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান।
খুনিরা কখনো হয়তো ভাবতে পারিনি যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কোন এক দিন দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের শুধু হালই ধরবে না, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন করবে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে সকল সকল বাধা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। সেই সময় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সরকার আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করবার চেষ্টা করেছিল। সেই ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসে তিনি শুধু আওয়ামী লীগকে সংগঠিতই করেনি, ১৯৯৬ সালে দলকে ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি কারণ ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০১ সালে যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারাই এক সময় খুনিদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরে শেখ হাসিনা শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়াই সম্পূর্ণ করেননি বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে আজ উন্নয়নের রোল মডেল। তবে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের ভেতরে যে মীরজাফরের দল প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল, সেই মীরজাফরের বংশধররা এখনো আওয়ামী লীগের মধ্যে অবস্থান করছে। তারাই আবার শেখ হাসিনার অবস্থানকে নড়বড়ে করতে চায়। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন দল থেকে আসা নব্য আওয়ামী লীগ গোষ্ঠি যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দলীয় সার্থকে সকল ক্ষেত্রে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে যেমন শ্রদ্ধা করতো এবং ভালোবাসতো, ঠিক তেমনি ভাবে তারা শেখ হাসিনাকে শ্রদ্ধা করে এবং ভালোবাসে। আর এই কারণেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের আস্থার স্থল হয়ে উঠেছেন।
এখানে বলে রাখা ভাল যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোন সরকার ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে এই দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। তবে কিছু অতি উৎসাহী নেতা-কর্মী রয়েছে যারা এই দিনটিকে এই দিনের তাৎপর্য থেকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে তাঁর কন্যাকে সহায়তা করা সকলের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তি নন, বরং প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসররা ক্ষমতায় থাকাকালে শত চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে। তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বাঙালির হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে আগামী প্রজন্মকে তাঁর আদর্শ ধারণে উৎসাহিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব হওয়া উচিত। এই দিনে বাংলাদেশ যা হারিয়েছে তার মর্মার্থ অনুধাবন করা সকলের উচিত। বড় বড় সভা সমিতি এবং অনুষ্ঠান করে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার দিন ১৫ আগস্ট নয়। আসুন সকলে মিলে শোক থেকে শক্তি সঞ্চার করি এবং সেই শক্তি দেশ গঠনের কাজে লাগায়। নিজেদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে এবং আগামী প্রজন্মের মাঝে এই আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেখানো যাবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/জিকেএস