অর্থনীতি

অর্থনীতিতে বিদ্যমান চাপ ‘সাময়িক’, বললেন বিশ্লেষকেরা

শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিই নয়, বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুরো বিশ্বব্যবস্থাই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, জ্বালানি সংকট এবং সাপ্লাই চেইনের বিপর্যস্ত অবস্থার মুখোমুখি। যার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতিতে, বেড়েছে মূল্যস্ফীতি। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতিতে বিদ্যমান যে চাপ তা ‘সাময়িক’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

Advertisement

রোববার (১৪ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

এতে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান ২০২১-২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের অর্থনীতির সার্বিক প্রেক্ষাপটের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সংকট ও কোভিড মহামারির প্রভাব, এলডিসি উত্তরণ, জাতীয় বাজেট ও মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন অবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাতের চিত্র তুলে ধরেন।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে গত অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ এবং আমাদের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া কোভিড মহামারির কারণে জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ নেমে এসেছে। যদিও গত অর্থবছর আমাদের রপ্তানি প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল।

Advertisement

তিনি জানান, এলডিসি উত্তরণের কারণে আমাদের রপ্তানি আয় প্রায় ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যেতে পারে। সম্ভাব্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যমান শুল্ক প্রতিবন্ধকতা নিরসন, বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সেপা)’ স্বাক্ষর এবং দ্রুত ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

রিজওয়ান রাহমান আরও বলেন, বৃহৎ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শতভাগ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পুরো রাজস্ব ও শুল্ক ব্যবস্থার অটোমেশন এবং করজাল সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের ঋণ নেওয়ার চাহিদা বাড়ার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আশাব্যঞ্জক নয়।

ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, বৈশ্বিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইন প্রভাবিত হওয়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ঊর্ধ্বমূল্য মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন দেশের সাধারণ জনগণ। এ অবস্থা নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করছে। স্থানীয় বাজারে ডলারের দামে অস্থিতিশীলতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের রেকর্ড ঊর্ধ্বমূল্যের প্রভাব দেশের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে ব্যাহত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন চেম্বার সভাপতি।

Advertisement

কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতের আধুনিকায়ন, চামড়াখাতে বন্ড লাইসেন্সের সীমা তিন বছর পর্যন্ত বাড়ানো, ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ট্যাক্স হলিডে সুবিধা সম্প্রসারণ এবং এপিআই উৎপাদনে ভ্যাট ও এসিডি প্রত্যাহার, হালকা প্রকৌশল খাতের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন ও স্বল্পসুদে ঋণ সহায়তা দেওয়া, বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো, সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যাংক ঋণ নীতিমালার সহজীকরণ ও নতুন সংজ্ঞায়ন এবং দেশে দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি স্থায়ী জ্বালানি নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম সম্প্রসারণের আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি।

ডিসিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, স্থানীয় বাজারে ডলারের ওপর চাপ কমানো, ব্যবসা-বাণিজ্যের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার শিগগির বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে উদ্যোগ নিয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পণ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তবে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমরা প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাঠাতে সক্ষম হয়েছি। ফলে আমাগীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বাড়বে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ পাট, চামড়া ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রভৃতি খাতের প্রতিটি থেকে ১ বিলিয়ন ডালারের বেশি পণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের রপ্তানি প্রবাহ আরও বাড়াতে সম্ভাবনাময় সব খাতের ওপর আরও নজর দিতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ জ্বালানি সংকটে ভুগছে। আমাদের টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে অফশোর গ্যাস কূপ অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি বাপেক্সকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা খুব ভালো নয়। সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। তারপরও আমাদের রিজার্ভ সাড়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম, যা বেশ স্বস্তিদায়ক। সরকার বিষয়গুলোকে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রখেছে।

নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মুদ্রাপ্রবাহ স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে অর্থনীতির গতিধারা অব্যাহত রাখতে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করে আসছে। বিশেষত কোভিড মোকাবিলায় বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে।

সেমিনারে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমাদের ম্যানুফেকচারিং খাতে গ্যাসের চাপ উল্লেখযোগ্য হারে কম থাকায় শিল্পকারখানায় পণ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় ব্যবসায় ব্যয় বাড়বে। মূল্যস্ফীতিও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে।

এমএএস/এমকেআর/এএসএম