রাজশাহী মহানগরীর পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ পরিণতির দিক লক্ষ্য রেখে মহামান্য হাইকোর্ট গত ৮ আগস্ট এক যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। রায়ে নগরীর ৯৫২ পুকুর অক্ষত ও প্রকৃত অবস্থায় রেখে সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত সেখানে যাতে আর কেউ কোনো পুকুর দখল বা মাটি ভরাট করতে না পারে তা সিটি কর্পোরেশন, আরডিএ এবং জেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য বিবাদিদের নিশ্চিত করতে বলেছেন।
Advertisement
এমনকি রাজশাহীর অনেক পুরাতন দিঘির দখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আদালতের এই নির্দেশ যেন কাগুজে বাঘ হয়ে না যায়। সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের উচিত হবে, সার্ভিস রুল মেনে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আইনের শাসন যেন দুর্বল হয়ে না পড়ে,সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া। মহামান্য আদালতের নির্দেশকে অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা করার অর্থই হলো আইনের শাসনকে বিপজ্জনক স্থানে নিয়ে যাওয়া। এতে সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। আস্থার সংকট তৈরি হবে।
পুকুরের শহর বলে খ্যাত রাজশাহীর পরিবেশ একসময় নির্মল ছিল। সুষম আবহাওয়া বিরাজ করতো। কিন্তু পুকুর ও বিভিন্ন ধরনের জলাশয় ভরাট,সবুজ এলাকা ধ্বংসসহ আরো কিছু কারণে আশঙ্কাজনকভাবে পরিবেশের বিপর্যয় হতে থাকে। এর সাথে যোগ হয় ভারতের ফারাক্কা বাঁধের নেতিবাচক প্রভাব। এতদাঞ্চলের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হতে শুরু করে। গরমের সময় প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয়।
আশির দশকের পর থেকে আইন লঙ্ঘন করে শুরু হয় একের পর এক পুকুর দখল ও ভরাটের মহোৎসব। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হতে থাকে। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাপমাত্রা অস্বাভবিক হয়ে পড়ে। তাপদাহ বৃদ্ধি পায়,পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে খরা। তীব্র গরমেও বৃষ্টির দেখা মিলে না। মাটি হারাতে থাকে আদ্রতা। দেখা দেয় পানির অভাব।
Advertisement
এই পানির অভাবে মাটি আরো বেশি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরের বাতাসকে উষ্ণ করে ক্রমান্বয়ে গরম বৃদ্ধি পেতে পেতে চরম পর্যায়ে চলে আসে। এই অবস্থায় পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে স্থানীয় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে বার বার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায়না। প্রশাসনের নাকের ডগায় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কয়েক বছরে শত শত পুকুর ভরাট করে বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে ফেলে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
পরিবেশ বিপর্যয়রোধে ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে "হেরিটেজ,রাজশাহী" নামের সংগঠন ২০১০ সালে পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। রায়ে ৩ মাসের জন্য পুকুর ভরাট নিষিদ্ধসহ আরো কয়েকটি নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তারপরেও প্রভাবশালীরা আইনকে তোয়াক্কা না করে পুকুর ভরাট অব্যাহত রাখে। পত্রিকায় এসব খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল কারও টনক নড়েনি। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, আরডিএ কেউই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
সম্প্রতি নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ড রামচন্দ্রপুর বাসার রোড সংলগ্ন বিহারীবাবুর পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধেও একটি আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. দেওয়ান মো. আবু ওবায়েদ হোসেন ২০১০ সালে 'হেরিটেজ,রাজশাহীর' পক্ষে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার আলোকে বিহারীবাবুর পুকুর ভরাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং আদালতের ৯৬২৬(২০১০) রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে কী কী ব্যবস্থা নেয় হয়েছে, তার জবাব ৭ দিনের মধ্যে দিতে বলেছেন। একইসাথে আইন লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে গত ২৬ জুলাই লিগ্যাল নোটিশও পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে।
এদিকে ২০১৪ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পুকুর ভরাট বন্ধ করার জন্য পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন "হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ" (এইচআরপিবি)-এর পক্ষে জনস্বার্থে হাইকোর্টে আরেকটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারির পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কতগুলো পুকুর আছে তা জানতে জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক রাজশাহী শহরে ৯৫২টি পুকুর আছে বলে প্রতিবেদন পাঠান জেলা প্রশাসক।
Advertisement
এরই মধ্যে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় "প্লট করে বিক্রির জন্য সংরক্ষিত দিঘি ভরাট " শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই সংবাদ সংযুক্ত করে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সব পুকুর সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে সম্পূরক আবেদন করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আবেদনের উপর শুনানি শেষে জারিকৃত রুল যথাযথ ঘোষণা করে উক্ত যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে রাজশাহী শহরের ৯৫২টি পুকুর অক্ষত ও প্রকৃত অবস্থায় রেখে সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এছাড়া শহরে আর যাতে কোনো পুকুর ভরাট ও দখল না হয় সেজন্য বন,পরিবেশ, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, আরডিএ'র চেয়ারম্যান, রাজশাহীর জেলা প্রশাসকসহ পুলিশ কমিশনারকে নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজশাহীর অনেক পুরাতন দিঘির দখলকৃত অংশ পুনরুদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণের নির্দেশও দিয়েছেন হাইকোর্ট।
গভীর দুঃখ এবং উদ্বেগের সাথে বলতে হয়, দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবে,পরিবেশ বিপর্যয়ের দিক লক্ষ্য রেখে সরকার জলাশয়, পুকুর, দিঘি, খাল-বিল ইত্যাদি রক্ষার্থে বহু আইন করেছে। কিন্তু খোদ সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারাই সেসব আইনকে অবজ্ঞা করে তা বাস্তবায়নে আগ্রহী হন না।
এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও কোনো ভূমিকা রাখতে চান না। তাদের নিজের এলাকার ক্ষতি হচ্ছে, সেটাও দেখে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যান। শেষ পর্যন্ত আদালতকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়। আদালতের এইসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে অনেকে আদালত অবমাননার মামলাও করেন। সেক্ষেত্রে অনেক সময় এ মামলাও দীর্ঘসূত্রিতার পথ ধরে এগিয়ে চলে। এরকম বহু নজির আছে। এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড আইনের শাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
বছরের পর বছর হাইকোর্টের রায় কার্যকর হয়নি, এমন খবরও অহরহ পত্রিকায় দেখা যায়। এমনকি আইনরক্ষার দায়িত্ব যে সকল প্রতিষ্ঠানের উপর, সে সকল প্রতিষ্ঠানকেও রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। দেশের সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইনে সুনির্দিষ্টভাবে পুকুর, জলাশয় সংরক্ষণের নির্দেশনাসহ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্বেও প্রশাসনের নাকের ডগায় রাজশাহী শহরে শত শত পুকুর দখল, ভরাট হয়ে গেছে কিন্তু কেউ কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেয়নি। এই ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের নির্দেশ কতদিনে, কীভাবে কার্যকর করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো-সেটিই এখন দেখার বিষয়।
১৩ আগস্ট শনিবার রাজশাহীর স্থানীয় পত্রিকায় এ সংক্রান্ত দুটি খবর বেরিয়েছে। একটি হচ্ছে, রাজশাহীসহ সংশ্লিষ্ট বরেন্দ্র অঞ্চলে জলবায়ু, পরিবেশ ও পানির সুরক্ষা নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন করেছে বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামের যুবকরা। দ্বিতীয়টির শিরোনাম হচ্ছে "বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি সংরক্ষণে খাল-বিল পুনঃখননের প্রস্তাব"। প্রস্তাবটি সরকারের তরফ থেকেই করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, রাজশাহীসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত শুষ্ক, তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি, বৃষ্টিপাত হয় অনিয়মিত সর্বোপরি ভূ-উপরিস্থ পানির স্বল্পতা আশংকাজনক।
আরেকটি খবর রাজশাহীবাসির জন্য উদ্বেগের। রাজশাহী মহানগরসহ ৫টি মহানগরীর উপর সম্প্রতি করা একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় বলা হয়, গত ৩০ বছরে এসব বড় নগরে প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংসের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। এখানে পুকুর, দিঘি ও অন্যান্য জলাশয় এবং সবুজ এলাকা দ্রুত কমে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। এসব ধ্বংস করার কারণে শহরগুলোতে দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। এসব পরিবেশগত দুঃসবাদ রাজশাহীবাসির জন্য সত্যি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার।
সংবিধানে বলা আছে, প্রশাসন এবং জনগণ সবাই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানতে বাধ্য। রায় বাস্তবায়ন না হলে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যায়। সুপ্রিম কোর্ট একটা রায় দিলে সেটা 'পাবলিক ডকুমেন্ট' হয়ে যায়। রাজশাহীবাসী আশা করে বিশেষ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তারা যেন নগরীর ৯৫২টি পুকুরসংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
আমরা রাজশাহীকে গ্রিন সিটি, হেলদি সিটি, ক্লিন সিটি বলে যতই গর্ব করিনা কেন; যে কয়েকটি পুকুর, দিঘি, জলাশয় এখনো জীবন্ত আছে, সেগুলো যদি অতি দ্রুত সংরক্ষণ এবং সংস্কারের ব্যবস্থা করা না যায়, তবে দর্প চূর্ণ হতে বেশি সময় লাগবে না। তাই রাজশাহীর সন্তান পরিবেশবান্ধব মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন আমাদের একমাত্র ভরসাস্থল। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, জন্মভূমির নাড়ির টানে তিনি রাজশাহীকে পরিবেশগত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হবেন।
লেখক: সাবেক সভাপতি, রাজশাহী প্রেসক্লাব এবং প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। golamss636@gmail.com
এইচআর/এমএস