দেশজুড়ে

জমিদার বাড়িতে দর্শনার্থী এলেই স্বাগত জানান মানবেন্দ্র নাথ

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারশ বছরের পুরোনো গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি। জমিদারি প্রথা বিলীন হলেও এ বাড়িতে এখনো বসবাস করছেন জমিদার অতুল চক্রবর্তীর বংশধররা। দেশ-বিদেশ থেকে আশা দর্শনার্থীদের স্বাগত জানান তারা।

Advertisement

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার গাঙ্গাটিয়া এলাকায় প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন জমিদার বাড়িটির অবস্থান। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িটি এখন ‘মানব বাবুর বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত।

গ্রিক সভ্যতার আদলে নির্মিত জমিদার বাড়ির সামনে দৃষ্টিনন্দন তোরণ। চারদিকে উঁচু দেওয়ালের মাঝে মাঝে ছোট ছোট প্রবেশ পথে সংস্কৃত ভাষায় ‘স্বাগতম’ লেখা আছে। বাড়ির প্রবেশ পথে প্রধান ফটক শ্রীধর ভবন। ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সবুজের সমারোহ। ছায়াঘেরা কয়েকশ গাছগাছালি আর ফুলের আধিক্য। মূল ফটক দিয়ে সামনে এগোলেই নানা শৈল্পিক কারুকার্যখচিত দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ।

প্রায় ১০ একর এলাকাজুড়ে জমিদার বাড়িতে রয়েছে প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা, দরবার, বৈঠকখানা, নহবতখানা, অতিথি কক্ষ, সঙ্গীতচর্চা কক্ষ, মন্দির ও সান বাঁধানো পুকুর ঘাট। প্রতিটি স্থাপনায় চোখে পড়বে সেসময়কার শৈল্পিক কারুকাজ। কক্ষের ভেতরে রয়েছে কারুকার্যখচিত খাট, পালঙসহ নানা আসবাবপত্র।

Advertisement

বাড়ির বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বেশিরভাগ অংশই সংস্কার করা হয়েছে। শহরের কোলাহলমুক্ত পরিবেশে সবুজের সমারোহ, বড় বড় পুকুর, অট্টালিকা আর ছায়াঘেরা প্রকৃতি যেন দর্শনার্থীদের হাতছানি দিচ্ছে। জমিদারবাড়ি দেখতে প্রতিদিন সেখানে ভিড় করেন কয়েকশ মানুষ।

বরিশাল থেকে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েসহ স্বজনদের নিয়ে ঘুরতে এসেছেন জীবন তাপস পাল। তিনি বলেন, ‘গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ির কথা অনেক আগে থেকে শুনে আসছি। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাড়িটি দেখতে এসেছি। জমিদারের বংশধরকে দেখে খুবই ভালো লাগছে।’

ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে বেড়াতে আসা মো. আনজু মিয়া বলেন, ‘এমন নিভৃত পরিবেশ, পরিপাটি আর সবুজের সমারোহ দেখতে খুব ভালো লাগে। তাই বন্ধুদের নিয়ে জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি।

কোলকাতা থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখেন অর্পনা সেন। তিনি বলেন, ‘জমিদার বাড়ির কথা শুনে এখানে এসেছি। এখানকার পুরোনো স্থাপত্য আর সামনের সবুজ গাছগাছালি মুগ্ধ করেছে। তবে এখানে বসার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলে ভালো হতো।’

Advertisement

ইতিহাস বলে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে গাঙ্গাটিয়ায় জমিদারি প্রথা শুরু করেন দীন নাথ চক্রবর্তী। পরে তার ছেলে অতুল চন্দ্র চক্রবর্তী আঠারো বাড়ির জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরানীর কাছ থেকে আরও দুই আনা-অংশ কিনে নেন। অতুল চক্রবর্তীর ছেলে শ্রীধর চক্রবর্তীর নামে জমিদার বাড়ির মূল ফটকের নামকরণ করা হয় ‘শ্রীধর ভবন’। শ্রীধর চক্রবর্তীর ছেলে ভূপতি চক্রবর্তী ছিলেন এ এলাকার শেষ জমিদার।

জমিদার বাড়িটির বর্তমান বংশধর হচ্ছেন মানবেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী চৌধুরী। তার নামেই এটি এখন ‘মানব বাবুর বাড়ি ’ হিসেবে পরচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের হামলায় মারা যান তার বাবা ভূপতি চক্রবর্তীসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন। এরপর পরিবারের সবাই ভারতে চলে গেলেও ভালোবাসার টানে এখানে রয়ে যান মানব বাবু। মরতে চান এ মাটিতেই। জমিদার বাড়ি দেখতে আসা লোকজনকে স্বাগত জানান সাধারণ পোশাকে।

মানবেন্দ্র নাথ চৌধুরী বলেন, ‘বাড়ি থেকে আমার বাবাসহ পূর্ব পুরুষরা জমিদারি চালিয়েছেন। এখন তারা নেই। জমিদারিও নেই। বেঁচে থাকা স্বজনরা সবাই ভারতে চলে গেছে। কিন্তু আমি এ মাটি ছাড়তে রাজি নই। এখানেই জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাতে চাই। তাই বাড়িটি কিছুটা সংস্কার করে দৃষ্টিনন্দন করেছি। সারা বছরই এখানে লোকজন ঘুরতে আসে। অমার খুব ভালো লাগে। যতোটা পারি তাদের সমাদর করার চেষ্টা করি।’

নূর মোহাম্মদ/এসজে/জিকেএস