কলকাতা গিয়েছেন কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পা রাখেননি এমন বাঙালি বোধকরি বিরল। বড় রাস্তা থেকে গলিটা পেরিয়ে বিশাল আঙ্গিনার লাল রঙের ওই বিশাল বাড়িটির সামনে দাঁড়ালে রবীন্দ্রনাথ আর ঠাকুরবাড়ির বিশালত্বের যে আঁচটা আজও অনুভব করা যায়, তা উপভোগ করার অমন সহজ সুযোগ কোনো বাঙালি হাতছাড়া করতে চায় বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
Advertisement
শান্তিনিকেতন কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায়, শপিং বা চিকিৎসার ফাকে যে সব বাঙালি এপার থেকে ওপারে পদার্পণ, তাদের অনেকেরই হয়তো শান্তিনিকেতনের শান্তিময় পরিবেশটা ঘুরে আসার সুযোগটা হয়ে ওঠে না, কিন্তু তাই বলে জোড়াসাঁকোয় না গিয়ে কলকাতায় অর্ধভ্রমণ সেরে ফিরে এসেছেন, এমন কোনো বাঙালির কথা আমার জানা নেই।
দুই.এক সময় বাংলা আর বাঙালিত্বের কেন্দ্রভূমি ছিল এই কলকাতাই। শুধু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য জোড়াসাঁকোই নয়, কলকাতায় আছে বাঙালির গর্বের এমনি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান কলকাতা মেডিকেল কলেজ। ১৭৬৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ইংরেজদের চিকিৎসার সুবিধার্থে প্রতিষ্ঠা করেছিল ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস, সংক্ষেপে আইএমএস।
মুম্বাই, চেন্নাই আর অবশ্যই কলকাতার সামরিক-বেসামরিক হাসপাতালগুলো পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আইএমএস অফিসাররা। তারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ আর সেনাবাহিনীতেও। এরা সবাই ছিলেন ইংরেজ। তাদের জন্য যে সব সাপোর্ট স্টাফ দরকার ছিল, যেমন- ওষুধ প্রস্তুতকারক, কম্পাউন্ডার, ড্রেসার ইত্যাদি সেই জায়গাগুলোয় স্থানীয়দের নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানিটি। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির ব্যয় কমিয়ে লাভটা বাড়িয়ে আনা। ১৮২২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করে দি নেটিভ মেডিকেল ইনস্টিটিউশন বা এনএমআই। এই প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ জন স্থানীয়কে এনাটমি, মেডিসিন ও সার্জারির পাশাপাশি ইউনানি ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। ১৮৩৩ সালে ডা. জন গ্রান্টের নেতৃত্বে একটি কমিটিকে এমএমআই পর্যালোচনার দায়িত্ব দেন বড় লাট লর্ড উইলিয়াম। গ্রান্ট কমিশনটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ভারতীয়দের অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য ১৮৩৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় কলকাতা মেডিকেল কলেজ, যার সংক্ষিপ্ত রূপ সিএমসি। ৪৯ জন ছাত্রকে মাসিক ৭ টাকা বৃত্তিতে ভর্তি করে সিএমসির পথচলা শুরু ১৮৩৫-এর ২০ ফেব্রুয়ারি।
Advertisement
ঠাকুরবাড়ির সাথে শুরু থেকেই ছিল সিএমসি-র ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দ্বারকানাথ ঠাকুর সিএমসি-র কৃতী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করতেন নিয়মিতই। তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমবারের মতো চারজন সিএমসি গ্র্যাজুয়েট বিলেতে গিয়ে দি রয়েল কলেজ অব সার্জন্সের মেম্বারশিপ অর্জন করেন। এদের মধ্যে অধ্যাপক সূর্য কুমার চক্রবর্তী ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম ভারতীয়। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিএমসির ম্যাটেরিয়া মেডিকা অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।
তিন.সিএমসি প্রতিষ্ঠার একশ বছরের বেশি সময় পর ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর বছরে কলকাতা শহরের স্বাস্থ্যসেবার ঐতিহ্য এবং গুণগতমান ছিল সেই সময়ের মানদণ্ডে আজকের সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। কবিগুরুর মৃত্যু হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সিএমসিতে চিকিৎসা নেননি তিনি। জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের দোতলার বারান্দায় তার জন্য স্থাপন করা হয়েছিল একটি অপারেশন থিয়েটার। ২০১৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নতুন গ্যালারি। কবিগুরুর জীবনের শেষ দিনগুলোর ঘটনাক্রম এখানে তুলে ধরা হয়েছে। যতবার ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছি, মন দিয়ে দেখেছি আর পড়েছি এই গ্যালারিটির ডিসপ্লেগুলো। আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে সাধারণের জন্য বেশি, আর গবেষকদের জন্য কম উপাদান সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
চার.অনুসন্ধান করে জানা যায়, ১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্জিলিংয়ের কালিম্পংয়ে গিয়েছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে বেড়াতে। সেখানেই ২৬ তারিখ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তার তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা আর প্রস্রাবে অসুবিধা হচ্ছিল। তার রোগটা মূত্রের ইনফেকশন হিসেবে শনাক্ত হয়। দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অপারেশনের পরামর্শ দেন, তবে তাতে সায় ছিল না প্রতিমা দেবী ও মৈত্রেয় দেবীর।
কবিগুরু নিজেও অবশ্য আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ওপরই আস্থা রাখছিলেন। খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় শান্তিনিকেতনে। বলা ভালো সেই ১৯১৬ সাল থেকেই কবির চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন ডা. নীলরতন সরকার, যার নামে কলকাতার মেডিকেল কলেজটি আজ পরিচিত। ১৯৪১-এ ডা. নীলরতন সরকার থাকতেন গিরিডিতে।
Advertisement
স্ত্রীর প্রয়াণের পর তিনি সেখানে চলে যান। ডা. নীলরতন সরকার অবশ্য কখনই কবিগুরুর অপারেশনের পক্ষপাতি ছিলেন না। ডা. সরকারের অবর্তমানে কবিগুরুকে শান্তিনিকেতনে দেখে আসেন আরেক কিংবদন্তির চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায়। তিনি অবশ্য অপারেশনের পক্ষেই মত দেন। তবে তাতে কবিগুরুর সম্মতি ছিল না।
পাঁচ.কবিগুরুর অপারেশনের সিদ্ধান্তটা হয় রোগটা আরও বেড়ে যাওয়ার পর। এ সময় তার প্রস্রাব প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। তিনি এ সময়টা তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকতেন। কবিগুরুর অপারেশনে সম্মতি দেওয়ার বিষয়টা নিয়েও আছে নানা মত। বলা হয়, তাকে জানানো হয়েছিল এটি ছোট্ট একটি অপারেশন। অপারেশনটা করিয়ে নিলে তার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটুকু কেটে যাবে এবং তিনি আরও কমপক্ষে ১০টি বছর লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবেন। জানা যায়, কবিগুরুর ঘনিষ্ঠ ডা. নীলরতন সরকারকে তার অপারেশনের বিষয়ে জানানো হয়নি, যেমনটি জানানো হয়নি কবিগুরুকেও, এন্টিবায়োটিক আর এমনকি পেনিসিলিনপূর্ব সেই যুগে এই ধরনের অপারেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর বিষয়েও।
ছয়.কী হয়েছিল কবিগুরুর? ধারণা করা হয় তিনি প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অপারেশনের পর ক্রমেই অবনতি ঘটে তার শারীরিক অবস্থার। একটা সময় জ্ঞান হারান তিনি। অপারেশন করার সময় অবশ্য কবিগুরুর প্রস্টেট গ্রান্ডে কিছু করা হয়নি, চিকিৎসকরা বাইপাস অপারেশন করে মূত্রথলিতে জমে থাকা প্রস্রাব বের করে এনেছিলেন। কবিগুরুর শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পেয়ে গিডিরি থেকে কলকাতায় আসেন তার প্রিয় সুহৃদ ডা. নীলরতন সরকার। কবিগুরুর শারীরিক পরীক্ষা শেষে, মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন ডা. সরকার। তার দু’চোখের কোনায় তখন জল।
সাত.১৯৪১-এর ২২ শ্রাবণ বেলা ৯টায় কবিগুরুকে শেষবারের মতো অক্সিজেন দেওয়া হয়। তাকে শেষবারের মতো দেখে যান ডা. বিধান চন্দ্র রায়। ঘড়ির কাঁটায় যখন ১২টা বেজে ১০, তখনই সব শেষ। কলকাতায় মেডিকেল কলেজটি স্থাপনের একশ বছর পরও জোড়াসাঁকোয় কেন কবিগুরুর অপারেশনটি করা হয়েছিল সে নিয়ে গ্যালারিটি দেখতে এসে কাউকে কাউকে মন্তব্য করতে শুনেছি। আমার অবশ্য মনে হয় সে সময়কার প্রেক্ষাপটে জোড়াসাঁকোয় অপারেশন থিয়েটার স্থাপন করে সে সময়কার সেরা চিকিৎসকদের দিয়ে, সব সময়ের অন্যতম সেরা এই বাঙালির চিকিৎসা করানোর এই উদ্যোগটি সেই সময় ও পারিপার্শ্বিকের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকই ছিল।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/ফারুক/এমএস