আন্তর্জাতিক মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ঋণ দেবার কথা জানিয়েছে। এটি একটি আনন্দের সংবাদ নিঃসন্দেহে। কারণ আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি থাকলেও সংকট নেই। তারপরও আগাম নিরাপত্তার লক্ষ্যে, নাকি ঘাটতি বাজেটের ক্ষুধা মেটাতে আইএমএফ-এর এই ঋণ নেয়া হচ্ছে- সেটা পরিষ্কার না হলেও ওই ঋণ যে অর্থনীতিতে শক্তি জোগান দেবে, তা না বললেও চলে।
Advertisement
আইএমএফ শর্ত দিয়েছে ভর্তুকি সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ যে সব আমদানিকৃত পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে জনগণের কাছে বিক্রি করা হয়, সেই ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। দাম বাড়ানোর আলামত গতরাতে টিভিতে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন।
শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। রাত ১২টার পর থেকেই নতুন এই দাম কার্যকর হয়েছে। ( প্রথম আলো/০৮/০৬/২২)
আজকের পত্রিকাগুলোতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে যানবাহনের হুমড়ি খাওয়া ছবি দেখা যাচ্ছে। রাত বারোটার আগে তেল কিনলে আগের দামেই পাবে গ্রাহকেরা। মোটরসাইকেলের চালকদেরও হুমড়ি খাওয়া ভিড় দেখে আমার অনেকটাই হাসি পেলো। মোটর সাইকেলের জ্বালানির কনটেইনারে কতোটা তেল আটবে যে তারা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে?
Advertisement
কিন্তু তাদের সাইকোলজিতে এই হুমড়ি খাওয়া যে ভীতির জন্ম দিয়েছে, সেটা আমরা বা সরকার গণ্য করছে না। সামান্য তেলের জন্য যখন এমন করে একজন মোটরসাইকেলের মালিক, তখন এটাই প্রমাণিত হয় যে, ওই মূল্যবৃদ্ধির অর্থনৈতিক অভিঘাত কতোটা। পেট্রোলে চালিত মোটর সাইকেলের প্রতিলিটারে দাম বাড়ানো হয়েছে ৪৪ টাকা। ফলে আজ শনিবার থেকে এক লিটার পেট্রোল কিনতে লাগবে ১৩০ টাকা। এই বাড়তি খরচ সাংসারিক জীবনে যে আর্থিক চাপ তৈরি করলো, সেই টাকাটা আসবে কোথা থেকে? চাকরিজীবী মানুষের তো বেতন বাড়েনি।
সরকারি দফতরের কর্মচারি-কর্মকর্তারা যে ঘুষের হারও বাড়াবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার যতই বলুন, তারা ধোয়া তুলসি পাতা, সেটা যে মিথ্যা বয়ান, তা কে না জানে, আর কে তা মানে? বেসরকারি অফিসগুলোর মানুষদের নাভিশ্বাস উঠবে এবার। আর যারা বেকার, যাদের সরকারি বেসরকারি কোনো খাতেই তাদের কোনো আয়-রোজগার নেই, তাদের কি হবে?
কি করা যায়, সেই চিন্তা থেকেই কি সরকার আইএমএফের দরোজায় নক করেছে? তবে সেই ঋণ কবে নাগাদ আসবে তার কোনো নির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। আইএমএফের প্রেসকিপশন অনুযায়ী ভর্তুকি সমন্বয় সাধিত হলো। এবার নিশ্চয়ই আইএমএফের হৃদয়ের দরোজা উন্মুক্ত হবে। এই ঋণটা এলে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়েছে, তা কমে আসবে। তখন স্বস্তিদায়ক একটি সামাজিক পরিস্থিতি আমরা ভোগ করতে পারবো।
এর আগে আমরা মন্ত্রী-মিনিস্টার ও এমপি এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে ফেনা তোলা বক্তব্য শুনেছি যে সরকারের রিজার্ভে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার সংরক্ষিত আছে, শঙ্কার কোনো কারণ নয়। সরকার যদিও স্বীকার করেছে যে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে, তবে তা শঙ্কিত হবার মতো নয়। রেমিট্যান্সের আয় খুবই ভালো। কিন্তু রফতানি খাতের আয় অনেকটাই কমেছে। এই বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের ঘাটতি সামগ্রিক ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, সেই ঘাটতি মোকাবিলা করা খুবই কঠিন কাজ। আয়ের এই ক্রমাবনতি আমাদের শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে।
Advertisement
আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষকের ফসল উৎপাদনে খরচ বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে কাচাবাজারে, ফসলের হোলসেল মার্কেটে। দাম বাড়বে বিদ্যুতের, এর মধ্যেই সে ঘোষণা এসেছে। কতো টাকা বাড়বে তা এখনো নির্ধারণ করেননি সরকার বাহাদুর। সড়কে-মহাসড়কে চলাচলকারী বাস-ট্রাক-লরির পরিবহন ব্যয় কতো বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে চর্চা হচ্ছে। অচিরেই তা জানবো আমরা। গ্যাস আমদানি না হলেও কেন যে মহামান্য সরকার এর দাম বাড়ান, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তবে বাড়ির প্রতিটি ডবল চুলার গ্যাসের চুলার দাম বাড়ানো হয়েছে ৯৪০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০ টাকা। কিন্তু গ্যাস ব্যবহারকারী শিল্পপতিদের বিল পরিশোধ না করার মানসিকতা নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ নেই।
এ-নিয়ে টুঁ-শব্দও করেন না তারা। যারা চোরাই লাইনে গ্যাস ব্যবহার করেন, সেই শিল্পপতিরা যে গ্যাস কোম্পানির লোকদের ম্যানেজ করে এটা বরছে সেটা ওপেন সিক্রেট হলেও, এনিয়েও ভাবিত নয় সরকার। যত পারে সরকার গণভোক্তা বা ব্যবহারকারীদের ওপর চোরদের গ্যাসের দাম বাড়াতে দফায় দফায় সমন্বয় সাধান করে।। সেই সাথে গ্যাসের সিস্টেমলস নামক চুরি এবং শিল্পসেক্টরে চোরাই দুই নম্বরী গ্যাসলাইন বন্ধের কোনো ওয়াদা বা ঘোষণা আসে না। বিদ্যুত সেক্টরেও বিল পরিশোধ না করা ও চোরাই লাইন কেটে দেবারও কোনো উৎসাহব্যঞ্জক তৎপরতা নেই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের মুখে।
মনে হচ্ছে বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে কোনোরকম চুরি ও সিস্টেম লস নেই। যা উৎপাদন করেন, তার পরিমাণও বলা হয় না। কেবল বলা হয় সক্ষমতার কথা। ২৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার পরও উৎপাদন ৮/১০ শর বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই প্রকৃত চাহিদা ১৪শ মেগাওয়াদের বিদ্যুৎ দিতে পারছে না সরকার। যে সরকার ঘোষণা করেছিলো যে তারা বিদ্যুৎ রফতানি করার জন্য রেডি হচ্ছেন, সেই সরকারের এমন করুণ অবস্থা দেখে আমাদের মনে হিটলারের গোয়েবস-এর কথাই মনে পড়ছে, যিনি তথ্য বিকৃত করে দুনিয়া জুড়ে হিটলারি শক্তিকে দেখাতেন। কিন্তু আজকে তো সরকারের সেই মিথ্যাচারে লাভ নেই।
বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। গত মে মাসের পর ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়ছে। এমন অবস্থায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে বড় সংকটে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত ছিল ঘাটতি সমন্বয়। দাম বাড়িয়ে ঘাটতি সমন্বয় করতে গিয়ে জনগণের ওপরের যে আঘাত হানা হয়েছে, তা সিডর–আইলার মতো ঘূর্ণিঝড়কে হার মানায়।
এম শামসুল আলম বলেন, দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করেও ঘাটতি সমন্বয় করা যেত। সরকার সেই পথে হাঁটেনি। জ্বালানি তেলের দাম গণশুনানি করে বাড়ালে তা সহনীয় থাকত। এখন যে ‘টর্নেডো’ চালিয়ে দেওয়া হলো, তাতে ভোক্তার অধিকার তছনছ হয়ে গেছে। (প্র/আ/ ০৮-০৬-২২
ক্যাবের সহসভাপতির বক্তব্য এদেশের ভুক্তভোগী মানুষের। সরকার সেই দিকে মন দেয় না কেন? কারণ বিদ্যুৎ চোর, গ্যাস-চোর, বিল চোর, সিস্টেমের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাটকারীদের ব্যাপারে সরকার কোনো কথা বলেন না, কারণ তারা তাদেরই রাজনৈতিক পোষ্য। এই রাজনৈতিক পোষ্যদের হাত থেকে দেশের সম্পদ বাঁচানোর দায় ও দায়িত্ব সবার আগে সরকারের। কিন্তু জবাবদিহিতা না থাকায় তারা যা নির্ধারণ করবেন, তাই আমাদের মেনে নিতে হবে। টুঁ শব্দ করা যাবে না।
আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়াতে হলে যে গণশুনানির আইনি রেওয়াজ আছে, হয়তো তা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও, তার ধার-ঘেঁষেও যাননি সরকার। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি দাবি করেছেন, সরকার সংবিধান লঙ্ঘন করে জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন কোনো ব্যাপারই না তাদের কাছে।
গত পঞ্চাশ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো এই লঙ্ঘনের কাজটি নির্বিঘ্নে করতে পারায় ওই সাংবিধানিক বিষয়টি ধুলির সঙ্গে মিশে গেছে। বরং বিরোধীদের নির্মভাবে দমন, দলন ও হত্যাই সরকারের রাজনৈতিক শিক্ষা ও মটো। ভোলায় ছাত্রদলের সভাপতিকে গুলি করে হত্যা করেছে পুলিশ। পুলিশের এই অমানবিক ও অনৈতিক আচরণ ঔপনিবেশিক শাসকদেরই অনুকরণ, অনুসরণ। তাদের মতোই আজকের সরকারও জনগণকে মনে করে তাদের প্রজা, তারা রাজা। কারণ তা এদের হাতে রাজদন্ডের ন্যায় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সরকারের ক্ষমতা বিদ্যমান। এই ক্ষমতা লুটে আনা হোক বা ব্যালটের মাধ্যমেই হোক, ক্ষমতাকে চটকে আলু ভর্তা করেই জাতিকে শাসন করতে শিখেছে রাজনীতিকরা।
সরকার কখনোই জনগণের নয়। তারা যদি ফেয়ার ইলেকশনের ভেতর দিয়ে ক্ষমতায় আসে, তারপরও তাদের রাজনৈতিক আচরণ ও প্রশাসনিক আচরণ জনগণের প্রতি নিবেদিত ও কল্যাণকর নয়। তারা জনগণের নামে নিজেদের উন্নয়নের পরিকল্পনা করে। যে দাম বাড়ানোর তরিকা তারা নিয়েছে, সেখানে জনগণের কাঁধে চাপানো হলো বিপুল ঘাটতির টাকা উত্তোলনের চাপ। অথচ, সিস্টেম লস ও চুরি বন্ধ করলেই আর কোনো পণ্যেরই দাম বাড়াতে হতো না। গোটা বিশ্বে এখন তেলের দাম কমেছে, এমন কি বিধ্বস্ত শ্রীলংকায় জ্বালানির দাম কমানো হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে বাড়ানো হলো। সরকার হলো এই রকম জনদরদি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস