একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসুস্থ ছিলেন। তিনি যখন ৩২ থেকে বের হন তখন জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছিল। নানামুখী চাপও ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। কি বলবেন, কতদূর বলবেন, এসব নিয়ে ছিল নানামুখী পরামর্শ। তার ওপর ছিল সাত কোটি মানুষের অসম্ভব প্রত্যাশার চাপটাও।
Advertisement
ঘর থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে বঙ্গমাতার সাথে পরামর্শ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরামর্শ চেয়েছিলেন ভাষণে তিনি কী বলবেন সে বিষয়ে। বঙ্গমাতা তাকে বলেছিলেন তিনি যা বিশ্বাস করেন তাই যেন তিনি লাখো মানুষের জনস্রোতে বলেন।
বঙ্গমাতার এই একটি পরামর্শেই সেদিন নির্ধারিত হয়েছিল বাংলাদেশের ভবিতব্য। বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন অন্য কোন আঙ্গিকে তার বক্তব্যটি সাজাতেন কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হতেন, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের আজকের ইতিহাসটা অন্যরকম হতো। বাঙালি জাতির ইতিহাস সৃষ্টিতে নেপথ্যচারী বঙ্গমাতার যে অসম্ভব অবদান এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র।
বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের যুগপৎ বিকাশে মহীয়সী এই নারীর আরও অসংখ্য-অজস্র অবদানের উদাহরণ ক্রমশই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কৃতজ্ঞ জাতি তাই তার জন্মদিনে আজ তাকে স্মরণে রাখছে অতল শ্রদ্ধায়। আমি জানি বঙ্গমাতাকে নিয়ে আজ এমনি আরও অনেক কলাম লেখা হবে। লিখবেন বিদগ্ধজনরা। নানা আলোচনায় উঠে আসবে তার জীবনের নানা দিক। আমি না হয় সেদিকটায় নাই-ই গেলাম।
Advertisement
আজ বাংলাদেশ আবারো একাত্তরের মতোই আরও একটা মহাসংকটে নিপতিত। পার্থক্য একটাই। সেবার ছিলাম আমরা একাকী আর এবার সাথে গোটা বিশ্ব। তাতে অবশ্য সংকটের মাত্রাটা না কমে বরং বেড়েছে। কারণ এবারের সংকটেও সেবারের মতোই আছে যেমন আমাদের অজস্র, অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী, আছে তেমনি প্রতিপক্ষও। সেবারের মতো এবারও এরা সক্রিয় ঘরের ভেতরে এবং বাইরে দু’জায়গায়ই।
পাশাপাশি এবার বদলে গেছে যুদ্ধের ধরনটাও। এবারের শত্রু দৃশ্যমান নয়, অদৃশ্য। প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে তার স্বরূপ। আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা আর সবশেষ অমিক্রণ ইত্যাদি নানা ভ্যারিয়েন্টের বেশে সে ক্রমশই আমাদের ওপর জেঁকে বসতে চাইছে। আর এই শত্রু একলা হারালেও তো চলছে না। একে তো হারাতে হবে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দুশটিরও বেশি ফ্রন্টে এবং তাও আবার একসাথে।
কাজেই কাজটা যে শুধু কঠিন তাই নয়, অসম্ভবের প্রায় কাছাকাছিও বটে। সাথে সংকটের মাত্রায় নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে আরও নতুন নতুন কিছু সংকট। ইউরোপের শস্যক্ষেতে বেঁধেছে রাশিয়া আর ইউক্রেনের লাঠালাঠি আর তার আঁচ এসে লাগছে এমনকি আমাদের এই বাংলাদেশেও। কারণ একদিকে যেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে শস্য আর জ্বালানির দাম, তেমনি যুদ্ধের ধাক্কায় সংকুচিত পশ্চিমা অর্থনীতি কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের রপ্তানি আর রেমিট্যান্স আয়ও। মানবতাকে শিকেয় তুলে আর মনুষ্যত্বকে ভাগাড়ে পাঠিয়ে তাদের সাথে যোগ দিয়েছে সেদিনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আজকের উত্তরসুরিরাও। মানুষের জীবন এখন পণ্য। হরিলুটের দোকান গজাচ্ছে এখানে-ওখানে। ‘মানি এখন দ্য গড এবং গড এখন দ্বিতীয় স্থানে’। আর এই যে বাস্তবতা এর ব্যাপ্তি শুধু দেশব্যাপী নয় বরং দেশের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী এবং বিশ্বব্যাপী আরও বেশি। এটিই নিউ নরমাল বৈশ্বিক ফেনোমেনন।
আর এই নিউ নরমাল বিশ্বে বাংলাদেশের সাহসী যাত্রায় যিনি নিঃসঙ্গ সৈনিক তার নাম শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গমাতার যোগ্য উত্তরাধিকার। একাকী তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন সতের কোটি মানুষের কোভিড যুদ্ধে। এদের ভরণ-পোষণ থেকে শুরু করে এদের প্রত্যেকের চুলোয় হাড়ি চড়ানোর দায়িত্বও এখন তার কাঁধেই। তার কাঁধে ভর করেই ভ্যাকসিন এখন যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে।
Advertisement
সেদিন বঙ্গবন্ধুর পাশে যেমন ছিলেন বঙ্গমাতা, আজ গণভবনে নিঃসঙ্গ নেত্রীর পাশে তার শরীরী উপস্থিতিটার বড্ড বেশি প্রয়োজন ছিল। ঘাতকের দল পঁচাত্তরে শুধু বাংলাদেশের বর্তমানকেই হত্যা করেনি, তাদের হত্যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও।
তাদের সেই আপাত সাফল্যের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে রোল মডেল তাবৎ বিশ্বের। বঙ্গমাতা আজ সাত আসমানের ওপারে যে স্বর্গীয় আবাসেই থাকুন না কেন সেখান থেকেই তার প্রার্থনা পাথেয় হোক তার প্রিয় জ্যেষ্ঠ কন্যার, তার জন্মদিনে আজ এতটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস