মতামত

রেণু থেকে বঙ্গমাতা

বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পাতা শুরু করেছিলেন সঙ্গী সহধর্মিণীর কথা দিয়ে, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’

Advertisement

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সী নারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে তিনি শাহাদতবরণ করেন। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৪৫ বছর।

বাল্যকাল থেকে যে মানুষটিকে জীবনসঙ্গী করে আমৃত্যু সাহচর্যের পণ করেছিলেন তিনি বিদায়ও নিলেন তার সঙ্গে। তাঁর জীবনের শুরুটা খুব সুখকর ছিল না। তিন বছর বয়সে বাবা আর পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যান জীবনের শুরুতেই। আর নিয়তি এটাই ঠিক করে রেখেছিল যে জীবনের শুরুর মতো শেষটাও তাঁর সুখকর হবে না। এক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে একসঙ্গে হারিয়ে যাবেন পুরো পরিবার নিয়ে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন পুরোটাই ছিল দেশের জন্য সমর্পিত। নিজ জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর সোনার বাংলার জন্য। সেই জীবনের, সেই স্বপ্নের অংশীদার ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। খোকা থেকে মুজিব ভাই হয়ে বঙ্গবন্ধু অথবা জাতির পিতা হওয়ার যাত্রাপথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় সেই পথের প্রতিটি বাঁকের সঙ্গী ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন, ‘অনেক সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি না আমার ছেলে-মেয়ের কাছে।’ যেকোনো মানুষই অনুধাবন করবে পাঁচ সন্তানের সংসার চালিয়ে নিতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে এই মহীয়সী নারীকে। অথচ তিনি কখনো প্রতিবাদ করেননি, বরং ইতিহাসের বাঁকে আমরা দেখেছি, যখন আপসের সুযোগ এসেছে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সেগুলো ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাই লিখেছেন, ‘আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’ জাতি হিসেবে আমাদেরও আজ সময় এসেছে স্বীকার করার এই মহীয়সী নারীর আত্মত্যাগের কাছে আমাদের ঋণ।

মহীয়সী এই নারী প্রেমময়ী স্ত্রী, স্বার্থ বিসর্জক, ত্যাগী নারী ও আদর্শ মাতা যেমন ছিলেন, অন্যদিকে নিজেকে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গড়ে তোলেন। চিন্তাচেতনা ও আদর্শের সমান অংশীদারি অর্জনে সমর্থ হন। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গী বহুমাত্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এই নারী মানুষের ভালোবাসা অর্জন করে হয়ে ওঠেন বঙ্গমাতা। প্রাথমিক জীবনে নিজের লেখাপড়া বেশি দূর না এগোলেও স্বামীর শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর নজর ছিল অতন্দ্র।

একদিকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার সামলানো, আবার কারাগারে গিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর মনোবল দৃঢ় রাখা; অন্যদিকে আইনজীবীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামলার খোঁজখবর নেওয়া। নিজের সোনার অলংকার বিক্রি করেও মামলার খরচ জুগিয়েছেন। নিজেকে বঞ্চিত করে তিনি স্বামীর আদর্শ ও সংগঠনের জন্য নিজের সম্বল প্রায় সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর স্বামী দেশের জন্য কাজ করছেন, মানুষের কল্যাণের জন্য করছেন। টাকার অভাব, সংসার চালাতে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নেতাদের সাহায্য দরকার, কেউ অসুস্থ তাকে টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তু কখনোই এসব কথা কাউকে বলতেন না। নীরবে কষ্ট করে সমস্যার সমাধান করেছেন।

এমনও দিন গেছে মামলা চালাতে গিয়ে তাঁর কাগজপত্র, উকিল জোগাড় করতে অনেক খরচ হয়ে গেছে। এদিকে বাজারও করতে পারেননি। কোনো দিন বলেননি যে টাকা নাই, বাজার করতে পারলাম না। চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছেন। আচার দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বলেছেন যে প্রতিদিন ভাত-মাছ খেতে ভালো লাগে নাকি। আসো, আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাই, এটা খেতে খুব মজা। একজন মানুষ, তাঁর চরিত্র কতটা সুদৃঢ় থাকলে যেকোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা ধারণ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পদে পদে তিনি আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। প্রকাশ্যে প্রচারে কখনোই আসেননি।

Advertisement

আওয়ামী লীগের মধ্যে সে সময় খুব গোলমাল। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আরেক দল ছয় দফা। ১৯ মে ১৯৬৬ সালে ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। ডেকোরেটর, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সে যুগে ছিল না, নিজ হাতে রান্না করে তিনদিন সবাইকে খাইয়েছেন বেগম মুজিব। সঙ্গে বিভক্ত নেতাদের নানা পরামর্শ দিয়েছেন, সাবধান করেছেন যেন ৬ দফা থেকে ৮ দফার দিকে চলে না যায়। বেগম মুজিবের মানসিক দৃঢ়তা সেই সময়ের রাজনৈতিক জাতীয় সংকট উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

বেগম মুজিবের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন তা আর ভুলতেন না। স্লোগান থেকে শুরু করে অনেক রাজনৈতিক পরামর্শ, নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত আসত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। নেতাদের নানামুখী পরামর্শে তিনি শুধু বলতেন, ‘লেখাপড়া জানি না কী বুঝব, খালি এটুকু বুঝি যে ৬ দফা আমাদের মুক্তির সনদ, এর বাইরে আমি কিছু জানি না।’ জেলখানা থেকে শেখ মুজিব দৃঢ় উচ্চারণে জানিয়ে দিয়েছেন, আর যাই হোক ৬ দফা থাকতেই হবে। ৬ দফা থেকে একচুল এদিক-ওদিক হওয়া যাবে না। বিশেষ কাউন্সিলের সভায় সিদ্ধান্ত হলো ৬ দফা ছাড়া আর কিছু হবে না।

দেশের উত্তাল পরিস্থিতিতেও প্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছেন জাতির জনককে। পাঁচ সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন এই মহীয়সী নারী। বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ইতিহাসে শুধু একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণী নন, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নেপথ্যের অন্যতম অনুপ্রেরণাদানকারী মহীয়সী নারী।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম