২৯ জানুয়ারির কথা। রাজশাহীতে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় দশম শ্রেণির ছাত্র তুর্য। আর তুর্যের মৃত্যুর সংবাদ শুনেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে কেয়া। তুর্যের সহপাঠি, বন্ধু, প্রেমিকা-কেয়া কোনোভাবেই এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারেনি এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পা বাড়িয়েছে অজানার দেশে। সংবাদপত্র সূত্রে ঘটনার বিবরণী অনেকটা এমন: পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় ঐদিন দুপুর পৌণে একটার দিকে তুর্য মোটর সাইকেলে করে বিনোদপুর বাজার থেকে বাড়িতে ফিরছিল। সেসময় মন্ডলের মোড় এলাকায় ইটবাহি একটি ট্রলির সঙ্গে মোটর সাইকেলের ধাক্কা লাগে। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তুর্যকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে তুর্যের মৃত্যুর খবর শুনেই তার সহপাঠি কেয়া নিজের শোবার ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে পরিবারের লোকজন তাকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলে নিয়ে যাবার পথে মারা যায় সে। তুর্য কেয়ার অসময়ে চলে যাওয়া প্রশ্ন রেখে যায় অনেক। প্রশ্ন রাখে সম্পর্কের বাস্তবভিত্তিক গাঢ়ত্ব নিয়ে, ভাবনার দোর খোলে মানুষের মন-আবেগ অনুভূতি-বাস্তব পরাবাস্তব জগতের বলয় ফেরে।অল্প কিছুদিন আগের কথা “কৈশরের প্রেম: প্রেম নাকি” নিয়ে আলোচনার অবতারণা করি এই কলামে এবং ওই লেখাটির মূল বক্তব্যই ছিল সমাজ, বাস্তবতা, মনোজগৎ সব আঙ্গিক থেকেই কিশোর বয়সের প্রেমকে প্রকৃত অর্থে প্রেম বলা চলে না। অথচ তুর্য কেয়ার চলে যাওয়া যেন ঐ বক্তব্যকে আক্রমণ করার জন্য জলজ্যান্তরুপে আবির্ভূত হলো। প্রেমের যুক্তি খণ্ডনের আগে আরেকটি সত্য ঘটনা না বললেই নয়। কলেজ পড়ুয়া দুই প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কে বাদ সাধে প্রেমিকার পরিবার এবং জোর করে মিরাকে (কাল্পনিক নাম) বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার চেয়ে মৃত্যুই ভাল ভেবে রাজীব (কাল্পনিক নাম) আর মিরা দুজনেই সিদ্ধান্ত নেয় একসাথে আত্মহত্যা করার। চিন্তা অনুযায়ী ঢাকার হাতিরঝিলে এক জলাশয়ে ঝাপিয়েও পড়ে দুজন একসাথে। কিন্তু কিছু পরেই মৃত্যুকে মূর্তমাণ দেখে সিদ্ধান্ত বদলায় মিরা। এবং অনেক চেষ্টায় একরকম সাঁতরেই পাড়ে উঠে আসে সে। কিন্তু হায়! রাজীব সামান্যতম সাঁতার না জানায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়। উপরের দুটি ঘটনাই মনকে নাড়া দেয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু পাশাপাশি দাবি রাখে বিশ্লেষণেরও। দুটি ঘটনাতেই প্রথমে যে বিষয়টির আলোচনা প্রয়োজন তা হলো, বয়সের অপরিপক্কতা এবং সম্পর্কের বাস্তব বিবর্জিত গাঢ়ত্ব নিয়ে। তুর্য কেয়া দুজনেই ছিল দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অনুমান করতে কষ্ট হয় না বয়স হয়তো ১৪ কি ১৫। যেকোনো শিশুর জন্যই এই কিশোর বয়সটি অত্যন্ত নাজুক। আর জীবনের এই পর্যায়ের যথেষ্ঠ বাস্তব জ্ঞানের অভাব, চিন্তার পরিপক্কতা ও পরিশীলতা আনার ক্ষেত্রে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসময়টিতে মানুষ যত না মাথা দিয়ে চিন্তা করতে পারে তারচেয়ে অনেক বেশি মন দিয়ে চিন্তা করে। বয়ঃসন্ধিকালে হরমোন পরিবর্তনের কারণে আবেগ অনুভূতি অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত থাকে। তাছাড়া বয়স-আবেগের সন্ধিক্ষণে হঠাৎ করেই ব্যক্তি নিজেকে বড় বুঝদার ভাবতে শুরু করে। ফলে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে যেমন এক রকম মোহ কাজ করে তেমনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও ভাবাবেগ দ্বারাই ব্যক্তি বেশি তাড়িত হয়। দুটি ঘটনাতেই অনিয়ন্ত্রিত আবেগের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কের বন্ধন আর বাকি সব সম্পর্কের নিবিড়তাকে তুচ্ছ করে দিতে পারে বলে আমরা দেখি। অথচ প্রতিটি মানুষই জন্মগ্রহণের সাথে সাথে সংযুক্ত হয় অগণিত নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্কের বন্ধনে। তবে কেন একটি সম্পর্ক বাকি সব সম্পর্ককে তুচ্ছ করে দেয়। এরও একমাত্র উত্তর বাস্তব বিবর্জিত আবেগ। তুর্যের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তৎক্ষণাত কেয়া যে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয় তখন সে কিন্তু তুর্য বলয়ের বাইরে একটি সম্পর্কের অবয়বকেও দেখতে পায়নি। একবারও ভাবতে পারেনি তার স্নেহময়ী মা, আদর্শ বাবা কিংবা ভালোবাসায় ভরা পরিবারের অন্য সদস্য ভাইবোনের কথা। এমনকি তাদের জীবনে কেয়ার গুরুত্ব, উপস্থিতি, অস্তিত্বও ভাবাতে পারেনি কেয়াকে। আর নিজের প্রতি ভালোবাসার প্রতিবিম্বতো একটিবারের জন্যও কেয়ার মানসপটে ভেসে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি কেবল তখন হয় যখন ব্যক্তি সকল যুক্তি তর্কের উর্ধ্বে উঠে শুধু ভাবাবেগে গা ভাসায় আর কিশোর বয়সে এই বিষয়টি ঘটতে পারে বারবার। তবে সকলের ক্ষেত্রে বিষয়টি একই হবে এমন ঢালাও মন্তব্য করার কোনো কারণ নেই। আর সেকারণেই টেনে এনেছিলাম মীরা ও রাজীবের ঘটনা। মৃত্যুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে মিরা সম্বিত ফিরে পেয়েছিল বলেই বেঁচে থাকার তাগিদে ভালবাসার পাত্রকে পিছে ফেলেই পাড়ি দিয়েছিল যমের পথ। তবে এক্ষেত্রে এ বিষয়টিও মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি মানুষ একই ঘটনায় একই প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। প্রতিটি মানুষ যেহেতু অনন্য তাই তার আচরণ অভিপ্রায়ও অনন্যই হবে। তবে যুক্তিযুক্ত কাঙ্খিত আচরণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির পরিবার-পারিপার্শ্বিকতার শিক্ষা, সাহায্য সহযোগিতা এবং সমর্থন। পরিবার থেকেই শুরু হতে হবে জীবনের মূল্য বোঝার শিক্ষা। জীবনের যেকোনো প্রতিকূলতা সামলে নেবার হাতেখড়ি হবে বাবা মায়ের কাছেই। প্রতিটি শিশুকেই জানতে হবে জীবনের ঘাত প্রতিঘাত মোকাবেলার কৌশল। পাশাপাশি তাদের মাঝে এমন দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে, জীবনের প্রতিটি বাঁকের সাথেই আছে মা বাবা আপনজন। তাছাড়া অভিভাবক শিক্ষক অথবা কাছের মানুষটির কাছে মনের কথা খুলে বলার সুযোগ থাকতে হবে শিশুর। বলতে হবে নির্ভয়ে নির্দ্বিধায়। কেয়া বা রাজীবের আপনজনেরা যদি জানতে পারতেন তাদের সম্পর্কের কথা তবে আজ অকালে ঝড়ে পড়তো না কোনো কেয়া বা রাজীব। রূঢ় বাস্তবকে মেনে নিয়ে জীবনের চলার পথের যাত্রী হতো তারাও। লেখক : শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়এইচআর/পিআর
Advertisement