রাজধানীর ওয়ারি এলাকার মলি নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন জাতীয় ছাত্র সমাজের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মিজানুর রহমান হিমু। কিন্তু হিমুর প্রথম স্ত্রী থাকায় বিয়েতে সম্মতি ছিল না শ্বশুর আলতাফ হোসেনের। এজন্য তিনি কোর্টে মামলা করে হিমুকে জেলও খাটান। প্রাণের ভয়ে হিমু ওয়ারি থানায় জিডিও করেছিলেন।কিন্তু কোনোভাবেই হিমুকে হেনস্তা করতে না পেরে হত্যার পরিকল্পনা করেন শ্বশুর আলতাফ। তিন লাখ টাকার কন্টাক্টে ভাড়াটে কিলারকে দিয়ে হিমুকে খুন করেন তিনি। হত্যার ঘটনার পর দায়ের করা মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে ও গ্রেফতারকৃত তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। হিমু হত্যার পর থেকেই তার পরিবার ও ভাইয়েরা দ্বিতীয় স্ত্রী মলির বাবা আলতাফ হোসেনকে সন্দেহ করে আসছিলেন।তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিলিং মিশনে অংশ নেন মোট তিনজন। তারা হলেন পেশাদার কিলার ওমর (৫০), আলতাফের ব্যবসায়িক পরিচিত রফিকুল (৪৫) ও শামীম (২৮) নামে খুলনার রূপসার এক যুবক।খুনের ঘটনায় অংশ নেয়া এ তিনজনই একে একে ধরা পড়েছেন রূপনগর থানা পুলিশের হাতে। গ্রেফতারকৃত সবাই ১৬৪ ধারায় আদালতে হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তবে খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আলতাফ এখনো পলাতক রয়েছেন।রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রেজাউল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম স্ত্রী লাবণ্য থাকতেও পেইন্ট (রং) ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেনের মেয়ে মলির সঙ্গে হিমুর প্রেম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে মলিকে তিনি বিয়েও করেন। কিন্তু বিয়ের পর প্রথম স্ত্রী লাবণ্য ও তাদের এক বাচ্চা থাকার বিষয়টি প্রকাশ পেলে বেঁকে বসেন আলতাফ হোসেন। পরে তিনি হিমুর বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করেন। সেই হামলায় হিমু বেশ কিছু দিন জেলও খাটেন। এ ঘটনায় ওয়ারি থানায় নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন হিমু।মেয়ে মলি এখন আমেরিকায় বসবাস করছেন এই সুযোগে মেয়েজামাই হিমুকে খুনের পরিকল্পনা করেন আলতাফ হোসেন। পরিকল্পনায় প্রথম অংশ নেন রফিককে সঙ্গে নিয়ে। রফিক আলতাফের ব্যবসায়িক সঙ্গি। রফিকই পরে রাজধানীর পল্লবী এলাকার পেশাদার খুনি ওমরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওমর সঙ্গে নেয় শামিমকে।গত ১৬ জানুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দোয়েল চত্বর থেকে কৌশলে ব্যবসার কথা বলে রফিক হিমুকে মিরপুর সনি সিনেমা হলের সামনে ডেকে নিয়ে যায় তারা। সেখান থেকে আরেক পার্টনারের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে রিকশাযোগে নিয়ে যায় পল্লবীতে। এখানেই কফির সঙ্গে নেশা জাতীয় পানীয় মিশিয়ে খাওয়ানো হয় হিমুকে। হিমু নিস্তেজ হয়ে পড়লে তারা মাইক্রোবাসে বিহারী ক্যাম্প ও পল্লবীতে যায়।পরে ইস্টার্ন হাউজিংয়ে পুনরায় ফিরে মাইক্রোবাসেই গলায় তার জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা চালায় রফিক। সেখানে বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা করে হিমু। আর তখনই হিমুর মাথায় পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করে শেষে গুলি চালায় ওমর। এরপর লাশ ফেলে দিয়ে চলে যায় তারা।রূপনগর থানার ওসি আরও জানান, রোববার ভোরে বকুলতলা বেড়িবাধের পাশে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের একটি খালি প্লট থেকে হিমুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে সময় হিমুর মাথায় আঘাতের চিহ্ন, গলায় দাগের চিহ্ন পাওয়া যায়।ওসি জানান, প্রাথমিকভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা নিয়েই তদন্ত শুরু হয়। পরে একে একে রফিক, শামীম ও ওমর গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য উঠে আসে। পরিকল্পনাকারী হিসেবে আসে শ্বশুর আলতাফের নাম।ঘটনার পর গত ১৭ জানুয়ারি হিমুর বড় ভাই হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে ৩০২/৩৪ ধারায় রূপনগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত করেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মতলুবুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গ্রেফতারকৃত রফিক আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে জানায়, ব্যবসায়িক কারণে রফিকের পরিচয় ছিল হিমুর শ্বশুর আলতাফের সঙ্গে।রফিক আলতাফের সঙ্গে প্রথমে পাঁচ লাখ টাকায় খুন করার প্রস্তাব দেয়। পরে মোট তিন লাখ টাকায় দফরফা হয়। রফিকই পরবর্তীতে ওমর ও শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুন করে হিমুকে। এ তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও বলেন, হিমু হত্যায় মূল পরিকল্পনাকারী তার শ্বশুর আলতাফ। খুনের ঘটনায় জড়িত সবাই গ্রেফতার হলেও আলতাফ পলাতক। তাকে ধরতে জোর প্রচেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।মামলার বাদী নিহতের ভাই হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, হিমুর বিরুদ্ধে মলির বাবা আলতাফ হোসেন ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ওয়ারি থানায় একটি মামলাও দায়ের করেন। এ মামলায় হিমু কিছুদিন জেলেও ছিল। এর মাঝে আলতাফ তার মেয়েকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন।হাবিবুর আরও জানান, জেল থেকে হিমু বের হলে আলতাফ তাকে ফের গুম করে হত্যা করার ভয় দেখান। এ ঘটনায় হিমু ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে একটি জিডি করেন।উল্লেখ্য, মিজানুর রহমান হিমু ২০১২-২০১৩ মেয়াদে জাতীয় ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক।জেইউ/বিএ
Advertisement