সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধর্মদর্শন: শেষ পর্ব

আমরা আগেই দেখেছি রবীন্দ্রদর্শন বিশেষ করে তাঁর ধর্মদর্শন গঠনে পারিবারিক প্রভাব কতো সাংঘাতিক। এও দেখেছি তাঁর চিন্তার মাঝে সমন্বিত হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্রোতধারা। এই মিলিত প্রবাহ যেন পড়েছে রবীন্দ্র সরোবরে। প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃতি, মুসলিম মোগল সংস্কৃতি বা পার্সিয়ানিজম এবং ইংরেজ মানবতাবাদ বা সেক্যুলার হিউম্যানিজম কীভাবে তাঁর জীবন সিঁড়িকে ওপরে নিয়ে গেছে তা আমরা লক্ষ্য করেছি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চেতনা গঠনে বৈশিষ্ট্য নির্ধারক সূত্র পেয়েছেন রামমোহনের উদার ও সমন্বিত দর্শনের কাছে। আরবি, ফার্সি, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত রাজা রামমোহন ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, সূফিবাদ, বৈষ্ণববাদ ও পাশ্চাত্য ধর্ম নিরপেক্ষ মানবতাবাদকে আত্মস্থ করেছিলেন। এর প্রভাব পড়েছিল রবীন্দ্র পরিবারে। মূলত এই বহুধর্মের একক সারসত্তা গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সারবত্তার উৎস উপনিষদ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতল পাণ্ডিত্য রবীন্দ্রনাথকে কতটা প্রভাবান্বিত করেছিল, গবেষকের লেখায় বোঝা যাচ্ছে। বীরেন্দ্র কুমার লিখছেন, “রাজা রামমোহনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে প্রগাঢ় ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল তা তাঁর অজস্র রচনার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু ধর্মজীবনের সাক্ষাৎ প্রভাব বলতে যা বোঝায় তা মহর্ষির কাছ থেকেই এসেছিল। রবীন্দ্রনাথের শৈশব কাল প্রধানতঃ কল্পনাশ্রয়ী হলেও মহর্ষির ধর্ম প্রভাব তথা ভারতীয় উপনিষদের প্রভাব কবির জীবনে তিলমাত্র অসার্থক হয়নি।” (পৃ ১১৯)

Advertisement

যে ধর্ম বিভেদের জোগান দেয়; সে ধর্ম তিনি গ্রহণ করেননি, বলছেনও না তার কথা। বলছেন সমগ্র মানব প্রজাতির মধ্যে যে ধর্ম কাজ করে চলেছে নিভৃতে সেই ধর্মের কথা। প্রদীপের আলো সামান্য একটা জায়গাকে আলোকিত করে, প্রদীপের চারপাশের অল্প একটু জায়গা ছাড়া এর কোনো সক্ষমতা নেই। কিন্তু যখনই ভোরবেলা নিখিল ভুবন উজ্জ্বল করে আকাশে সূর্য উঠে পড়ে; তখন সে আলোকিত করে সমস্ত প্রান্তর, সমস্ত ভূমি। খণ্ডিত ধর্ম শুধু একটি জাতিকে আলোকিত করে কিন্তু সব মানব জাতিকে আলোকিত করার জন্য চায় একক ধর্ম, অখণ্ড বিশ্ববোধ। প্লেটো যেমন তাঁর ধারণা তত্ত্বের মধ্যে সর্বজনীন ধারণার ইঙ্গিত দিলেন ঠিক রবীন্দ্রনাথের ধর্মও বোধকরি সেরকম। তিনি ‘ধর্মের সরল আদর্শ’তে বলছেন, “আমার গৃহ কোণের জন্য যদি একটি প্রদীপ আমাকে জ্বালিতে হয় তবে তাহার জন্য আমাকে কত আয়োজন করিতে হয়—সেটুকুর জন্য কত লোকের ওপর আমার নির্ভর। কোথায় সর্ষ বপন হইতেছে, কোথায় তৈল নিস্কাশন চলিতেছে, কোথায় ক্রয় বিক্রয়, তাহার পরে দীপ সজ্জারই বা কত উদ্যোগ—এত জটিলতায় যে আলোকটুকু পাওয়া যায় তাহা কত অল্প। তাহাতে আমার ঘরের কাজ চলিয়া যায়, কিন্তু বাহিরের অন্ধকারকে দ্বিগুণ ঘনীভূত করিয়া তোলে। বিশ্বপ্রকাশক প্রভাতের আলোককে গ্রহণ করিবার জন্য কাহারও উপরে আমাকে নির্ভর করিতে হয় না, তাহা কেবলমাত্র জাগরণ করিতে হয়। চক্ষু মেলিয়া ঘরের দ্বার মুক্ত করিলেই সে আলোককে আর কেহ ঠেকাইয়া রাখিতে পারে না।” (৩৪) এটা ঠিক ক্ষুদ্র আলোকের জন্য অনেক ঝক্কি কিন্তু বৃহৎ আলোক যে সব প্রাণকে ছাপিয়ে যায়। তিনি আরও লিখছেন, “এই আলোক যেন ধর্ম। তাহাও এই রূপ অজস্র, তাহা এইরূপ সরল। তাহা ঈশ্বরের আপনাকে দান-তাহা নিত্য, তাহা ভূমা।” (৩৪)

ধর্ম মানেই বিভাজন, কলহ, অনৈক্য, তথা দলাদলি—সাধারণের এমন প্রত্যাক্ষনুভূতি সম্পর্কে তিনি বলেন, “সর্বান্তঃকরণে আমরা নিজেকে ধর্মের অনুগত না করিয়া, ধর্মকে নিজের অনুরূপ করিবার চেষ্টা করিয়াছি।” (ধর্মের সরল আদর্শ, ধর্ম, ৩৫) ধর্মকে আমরা যখন গৃহের অন্যান্য আবশ্যকীয় দ্রব্যের মতন নিত্যদিনে ব্যবহারিক দ্রব্য করে তুলি; তখন ধর্মের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়, নষ্ট হয় এর চিরায়ত দর্শন। তাহলে ধর্মকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে? ধর্ম সর্বজনীন, সর্বশ্রেষ্ঠ। ধর্ম সর্বব্যাপী ও বিকারহীন। খণ্ডিত হলে ধর্ম থাকে না। ধর্ম ভূমা, অস্পর্শিত ও অনন্ত। সব মানুষের ভেতর নিরন্তর বয়ে যাওয়া অখণ্ড আলোক হচ্ছে ধর্ম। কিন্তু বিভেদ ডেকে আনে বিপর্যয়। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “কিন্তু ধর্মকে ধারণা করিতে হইবে তো? ধারণা করিতে হইলে তাহাকে আমাদের প্রকৃতির অনুযায়ী করিয়া লইতে হয়। অথচ মান-প্রকৃতি বিচিত্র, সুতরাং সেই বৈচিত্র অনুসারে যাহা এক তাহা অনেক হইয়া ওঠে। যেখানে অনেক সেখানে জটিলতা অনিবার্য, যেখানে জটিলতা সেখানে বিরোধ আপনি আসিয়া পড়ে।” (ধর্ম, ৩৬)। তিনি আরও বলেন, “ধর্মরাজ ঈশ্বর ধারণার অতীত। যাহা ধারণা করি তাহা তিনি নহেন; তাহা আর-কিছু, তাহা ধর্ম নহেন, তাহা সংসার। সুতরাং তাহাতে সংসারের সমস্ত লক্ষণ ফুটিয়া ওঠে। সংসারের লক্ষণ বৈচিত্র, সংসারের লক্ষণ বিরোধ।” কিন্তু এই বিভাজ্য মানসিকতায় এক মানবধর্ম চলবে কী করে? উপনিষদ ব্যাখ্যা দিচ্ছে, “যো বৈ ভূমা তত সুখং নাল্পে সুখমস্তি”। যা কিছু ভূমা তাতেই সুখ, যা ভূমি তা অল্প যার পর নাই সেখানে সুখ নেই। দুঃখ তখনই সৃষ্টি হয় যখন ভূমাকে আমরা ধারণাযোগ্য করে নিই। তাহলে সমাধান কোথায়? তিনি বলছেন, সংসারে বাস করে যখন ভূমাকে উপলব্ধি করি। “সংসার দ্বারা ভূমাকে খণ্ডিত জড়িত করিলে চলিবে না”। (ধর্ম, ৩৭)

সাকার ও নিরাকারসাকার নিরাকার বিতর্কটা সেই চিরচেনা সীমা-অসীমের বিতর্ককে উস্কে দেয়। ভারতবর্ষে এক সময় এই বিতর্ক ছিল তুঙ্গে বিশেষ করে হিন্দুধর্ম ও হিন্দুধর্মের উপজাত বাহ্মধর্মের মধ্যে যখন ঈশ্বর উপাসনার ধরন নিয়ে বিতর্ক চলছে, দলাদলি ভয়ানক আকার পেয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথ কলম ধরেন। ১২৯২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে ভারতী পত্রিকায় “সাকার ও নিরাকার” উপাসনা নিয়ে একটা নিবন্ধে কিছুটা হলেও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। খুব সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মমতের অনুসারী হওয়ার ফলে নিরাকার মতের পক্ষে বাহাস করেন। তবে সাকার উপাসনা যে একেবারে নিরর্থক সেটাও বলা যায় না। সাকার উপাসনায় আমরা কতটুকু পাই, নিরাকার পথেই বা কতটুকু—এই বিবেচনাটা সবার আগে। রবীন্দ্রনাথকে আমরা যতটুকু বুঝি তাতে মনে হয় তিনি আকারহীন উপাসনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ আকারের মধ্যে একটা সীমানা চলে আসে, আকারের মধ্যে অসীমতা খর্ব হয়। বিশ্ববিধাতা তো অসীম, এর কূল পাওয়ার চেষ্টা কি অবান্তর নয়? তিনি বলছেন, সীমার মধ্যে আমাদের সুখ নেই—‘ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি’। অসীমের পানে মানুষের মন ছোটে এর কারণ সীমা যে তৃপ্তি দেয় তার ভেতর আমরা যেন খুঁজে পায় না আমাদের গন্তব্যকে। এতে প্রয়োজন হয়তো মিটে যায় কিন্তু মনের অসীম ক্ষুধার তো পরিতৃপ্তি হয় না। রবীন্দ্রনাথ অসীমত্বের মাঝে সৌন্দর্য খুঁজেছেন, সেটা যেমন তাঁর শিল্পবোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি সত্তা বিষয়ক অন্টলজিক্যাল দিক থেকেও সমান দরকারি।

Advertisement

‘সৌন্দর্য প্রয়োজনের বাড়া’—এর অর্থের মধ্যেই রয়েছে অসীমত্বের প্রতি রবীন্দ্রানুভূতির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রয়োজনের একটা সীমানা আছে, আছে তার কেজো প্রকৃতি। ওটা আটপৌরে যা নিত্যদিনের ব্যবহারের ফলে ওর মর্ম আমাদের মনকে স্পর্শ করে না। যেমন করে না ক্ষুদ্র পুকুর বা দীঘির জল। সমুদ্রের অসীম জলরাশি প্রাণকে ভরিয়ে দেয় কারণ ওর কোন কূল নেই, যা অকূল যা কিনারাহীন আর অসীমের দিকে প্রসারিত তাই আমাদের চাওয়া। পৌত্তলিকতাকে তিনি একটা অসীমকে সীমানার মধ্যে আনার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। আমরা যতটুকু দেখি তার থেকে যা দেখি না তাই বিশাল। অর্থাৎ দৃষ্টির সীমানার চেয়েও অ-দৃষ্টির বাস্তবতা আরও বেশি সত্য। তাঁর নিজের কথায়, “যেখানে চক্ষুর কোন বাধা নাই এমন এক প্রশস্ত মাঠে দাঁড়াইয়া চারি দিকে যখন চাহিয়া দেখি, তখন পৃথিবীর বিশালতা অনুভব করিয়া আমাদের হৃদয় প্রসারিত হইয়া যায়। কিন্তু কি করিয়া জানিলাম পৃথিবী বিশাল? প্রান্তরের যতখানি আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছে ততখানি যে অত্যন্ত বিশাল তাহা নহে। আজন্ম আমরণ কাল যদি এই প্রান্তরের মধ্যে বসিয়া থাকিতাম আর কিছুই না দেখিতে পাইতাম তবে এইটুকুকেই সমস্ত পৃথিবী বলিয়া মনে করিতাম।” (১৭তম খণ্ড, ৩৩৮)। তাহলে আমরা কেন পৌত্তলিকতাকে গ্রহণ করবো?

তাহলে কবিতার কী হবে? মানুষের মনের গহীন অন্তঃপুরে যে ভাররস ঘনীভূত হয় তা যখন আকার পায় তখন হয়ে ওঠে কবিতা। তাহলে কি সেটা পৌত্তলিকতা হয়ে উঠবে না? অর্থাৎ কবিতা কি পৌত্তলিকতা? রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “কবিতা পৌত্তলিকতা নহে”। ভাবাভিনয়ের স্বাধীনতাই কবিতা। ভাবের একটা আকার দেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু সেখানে যে শিল্পীর স্বাধীনতা বিদ্যমান। কাজেই “ঈশ্বরকে আমরা হৃদয়ের সংকীর্ণতাবশত সীমাবদ্ধ করিয়া ভাবিতে পারি কিন্তু পৌত্তলিকতায় তাহাকে বিশেষ একরূপ সীমার মধ্যে বদ্ধ করিয়া ভাবিতেই হইবে।” (প্রাগুক্ত, ৩৩৮)। অবশ্য তিনি এও বলেন, অনেক সময় মানুষের এই উপায়টাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যেটা মনুষ্য প্রকৃতিরই ধর্ম। এতে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না।

রবীন্দ্রনাথের দাবী, “অসীমতা কল্পনার বিষয় নয় বরং সীমাই কল্পনার বিষয়”। কিছুটা খটকা লাগলেও তিনি এই ব্যাখ্যা দেন যে, সীমার মাঝে কোনকিছুকে আনতে পারা অত্যন্ত কষ্টের ব্যাপার। কারণ দিগন্ত জোড়া যে আকাশ তাকে কতটুকু দৃষ্টিসীমার মধ্যে কল্পনা যায়? কতটুকু কল্পনার মধ্যে আনতে পারলে স্বস্তি লাগে? এটা অত্যন্ত অকল্পনীয় ব্যাপার। তাই তো আমরা সমুদ্রকে বলি অসীম, আকাশকে বলি অসীম। সীমা অগণিত কিন্তু অসীম এক; সীমাতে শ্রান্তি অসীমে শান্তি। তবে পরিশেষে তিনি সীমা ও অসীমের মাঝে জগতকে দেখতে চেয়েছেন। সীমা যেমন চিন্তার উপাদান দেয় তেমনি অসীম দেয় আকার। অসীমেরও যে আকার আছে! এই আকার ও নিরাকার সৃষ্টি করে মানব চিন্তার দুমুখো স্বভাব। তাই তিনি বলছেন, কবিতায় আমাদের রিয়েলিস্টিক ধারার প্রয়োজন আছে, তেমনি আছে সাজেসটিভ ধারা। বস্তুগত ও ভাবগত গুণের ভেতর দিয়ে আমরা প্রকাশ করি নিজের একান্ত অনুভূতি।

যা-ই হোক, রবীন্দ্র ভাবনার বিশেষ করে তাঁর ধর্মানুভূতি এক বিশেষ মাত্রায় অভিষিক্ত। তাঁর ধর্মচিন্তা যেন বিশ্বধর্মের এক অখণ্ড চেহারা, এক মানব অনুভূতির তীব্রতম প্রকাশ। লক্ষ্য করতে হবে, রবীন্দ্র কাব্যিক অনুভূতি আর ধর্মবোধ একই সুরে ধ্বনিত। একই মহাসাগরে পতিত বিভিন্ন স্রোত। এ স্রোতধারা তিনি অর্জন করেছেন বহুত্ববাদী ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা থেকে। বিখ্যাত রবীন্দ্র বায়োগ্রাফার টমসন লিখছেন, “In no other family than that of the Tagores could all the varied impulses of the time have been felt so strongly and fully. These impulses had come from many men. Rammohan Roy had flung open doors ; Derozio and others had thrown windows wide ; Keshab came and intellectual and religious horizons were broadened. The tide of reaction had been set flowing by the neo-Hindu school, in battle with whom the poet was to find his strength of polemical prose, his powers of sarcasm and ridicule ; and poets and prose-writers had established new forms, and given freedom to old ones . Rabindranath was fortunate in the date of his coming”. এসইউ/এমএস

Advertisement