পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত হিংস্রতায় মানুষের কোনও তুলনা নেই। অথচ মানুষেরই সব নৃশংস কাণ্ডকারখানায় অনায়াসে ‘পাশবিক’ বিশেষণ যোগ করে দেয়। টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ভয়ংকর বার্তা দিল পুরো সমাজকে।
Advertisement
সড়কে বা যানে মানুষ কোথাও নিরাপদ নয়। দেশের সড়কগুলোয় গণহত্যার মতো দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি অনিরাপদ জানমাল। টাঙ্গাইলের মধুপুরে ঈগল এক্সপ্রেসের একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা বলে দেয় কতটা জীবন বাজি রেখে চলতে হয় সাধারণ মানুষকে।
বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন দুঃখজনক ও ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। অনেকে ধরা পড়ে, কিন্তু প্রবণতা কমছে না। একটা বড় কারণ এসব মামলায় বিচার সম্পন্ন হতে অনেক সময় লেগে যায়। মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত অপরাধের গুরুত্ব তেমন লক্ষ্য করা যায় না। তাই অনেক সময় উপযুক্ত শাস্তিও অপরাধীরা পায় না। দ্বিতীয় বড় কারণ হাইওয়ে পুলিশের সক্রিয়তার অভাব।
মধুপুরের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। কুষ্টিয়া থেকে বাসটি নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিল। বাসটি যমুনা ব্রিজ পার হওয়ার পর হাত দেখিয়ে রাস্তায় বাস থামিয়ে বেশ কিছু যাত্রী বাসে ওঠে। তারাই বাসের যাত্রীদের হাত-মুখ বেঁধে টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়। এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণও করে।
Advertisement
বাসটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা তিনঘন্টা ধরে নিজেরা চালিয়েছে, সেই চালানো ছিল অপরিপক্ক হাতের। প্রায় তিন ঘণ্টা পর টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়ায় বাসটি রাস্তার পাশের বালুর ঢিবিতে পড়লে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। তিন ঘন্টা একটা বাস আকাবাকা চলল, অথচ হাইওয়র পুলিশ কোন তথ্য পেল না?
পরিবহন মালিকরাও এই দায় এড়াতে পারেন না। গণপরিবহনের একটা নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। হাইওয়ে পুলিশও বাসে তল্লাশি চালায়। কোন পক্ষই বাসের নিরীহ যাত্রীদের এই সর্বনাশ থেকে রক্ষা করতে পারল না।
দেশের একজন সাধারণ মানুষ যাত্রাপথে নিরাপত্তা পাবে না, ডাকাতরা লুট করে নিয়ে যাবে, নারীদের ধর্ষণ করবে- এই হলো অবস্থা! আমাদের মনে থাকবার কথা ২০১৭ সালের ঘটনা। সে বছর ২৫ আগস্ট রাতে মধুপুরে চলন্ত বাসে এক ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করে পঁচিশমাইল এলাকার রাস্তায় ফেলে দেন আসামিরা। এ ঘটনায় করা মামলায় ছোঁয়া পরিবহনের চার শ্রমিককে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন টাঙ্গাইল জেলা আদালত। কিন্তু মহাসড়কে যেসব অপরাধ সংগঠিত হয় সেগুলোর অধিকাংশেরই বিচার হয় না।
পরিবহন মালিক শ্রমিকরা একজোট হয়ে নৈরাজ্য করতে, যাত্রী ও সরকারকে জিম্মি করতে যতটা তৎপর ততটা উদ্যোগী নন যাত্রী নিরাপত্তায়। যেখানে সেখানে যাত্রী তোলা ও নামানো, সরকার ও মানুষকে জিম্মি করায় এরা সব যতটা একতাবদ্ধ ততটা উদ্যোগী নয় যাত্রীদের সেবা ও নিরাপত্তা দিতে।
Advertisement
সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে দেখা যায় সড়কে যেসব যানবাহন প্রতিদিন একচোখা গন্ডারের মতো তাণ্ডব চালাচ্ছে, এগুলোর নিয়ন্ত্রক-পরিচালকদের হাত আরও অনেক বেশি লম্বা। সরকার বা আদালত এদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। প্রতিদিন এত যে দুর্ঘটনা ঘটছে- এত যে জীবনহানি হচ্ছে, তা সরকারি কর্তৃপক্ষের এতটা গা সওয়া হয়ে গেছে যে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াই যেন হচ্ছে না। এখন নতুন উপদ্রপের নাম যাত্রী বেশে ডাকাতি ও ধর্ষণ।
নানা ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয় প্রচেষ্টা সর্বত্র আলোচিত। অনেক বেশি নির্মাণ কাজ হয়েছে সড়কে, অথচ সড়ক এখন সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। সড়ক নৈরাজ্য আর উশৃঙ্খলতায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে সরকারের নানা সাফল্য। কারণ সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা না দিতে পারার মতো ব্যর্থতা সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই নানা দুর্ঘটনার চিত্র দেখছি। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। কত সংসারের স্বপ্ন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে।
বড় সমস্যা হচ্ছে, সব যানবাহনের শ্রমিক সংগঠন বা মালিক সংঘ কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। সরকারের বা সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত অনেক প্রভাবশালীর নাম শোনা যায়, যারা বাস-ট্রাকের মালিক। আইন প্রয়োগ যারা করবেন তাদেরও অনেকের বাণিজ্য আছে এই খাতে। ফলে পুলিশ প্রশাসন অসহায় হয়ে পড়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে।
২০১৮ সালে শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন কী আমাদের শিখিয়ে তদেয়নি যে চাইলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সক্ষম? মহাসড়কে যাত্রী ও পরিবহনের নিরাপত্তায় প্যানিক বাটনের মতো প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু পরিবহন মালিক পক্ষ সেটা করবেন না। তারা শুধু লাভই খুঁজবেন।
এই বাটনটি ড্রাইভারের হাতের কাছে থাকে, কোনো ডাকাতি বা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলে ড্রাইভার প্যানিক বাটনে চাপলেই পুলিশের কাছে তথ্য চলে যাবে। কেন প্যানিক বাটনে আগ্রহী নয় পরিবহন মালিক পক্ষ তার কারণ বোঝা যায়। এটি থাকলে রিয়েল টাইম ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে সবসময় গাড়ির অবস্থান নিশ্চিত করা যাবে। মালিক ও পুলিশ গাড়িটির রুট ট্র্যাক করতে পারবে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বাসটির সব তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। গাড়িটির মাইলেজ রিপোর্ট পাওয়া যাবে। গাড়িটি ওভার স্পিড হলে চালককে সতর্ক করা যাবে। এখানেই পরিবহন মালিক শ্রমিকের আপত্তি। তারা কোন সিস্টেমে আসতে চায় না।
সরকারের কাছে প্রত্যাশা, যানবাহনের মালিকপক্ষ ও দানবীয় শ্রমিক পক্ষকে পরোয়া না করে শক্ত হাতে আইন মানানোর ব্যবস্থা করা হোক। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হোক। আইন না মানা পথচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সব পক্ষকে আইন মানতে বাধ্য করতে পারলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সার্বিকভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনার সব বাধা জিরো টলারেন্সের শক্তিতে অপসারিত হোক।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস