দেশে একটি শিক্ষানীতি আছে। বিভিন্ন সময় গৃহীত শিক্ষা কমিশনও দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কাজ করেছে। স্বাধীনতার পরে প্রথম গৃহীত হয় কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন। এরপর বিভিন্ন সময় আরও তিনটি কমিশন প্রণয়ন করা হয়েছে।
Advertisement
২০১০ সালে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার পর থেকেই একটি শিক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য ২৪টি উপ-কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করার জন্যও একটি উপ-কমিটি করা হয়। এক দশক পর সেই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সংসদে উত্থাপিত হলে এটি আইন হিসেবে পাস হবে।
বহুদিন ধরেই দেশে একটি সর্বজনীন ও সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতেও সেই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন রয়েছে। নতুন শিক্ষা আইনে চার স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা আছে। এর বাইরে বিদেশি শিক্ষাক্রম, মাদরাসা শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। আইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নিবন্ধন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমোদন নেওয়াসহ বেশ কয়েকটি বিধান যুক্ত থাকছে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নানা সমস্যা-সংকট রয়েছে। সেগুলো সমাধান শুধু আইন দিয়ে হবে না। এর সঙ্গে ব্যবস্থাপনা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও আরও নানা সামাজিক অনুষঙ্গ জড়িত। তবে আইনে কয়েকটি বিষয় সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। শৈশব থেকেই শিক্ষার শুরু। প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের মৌলিক অধিকার। আইনে প্রাথমিক শিক্ষা শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও নানাবিধ কারণে শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি।
Advertisement
দেশের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা চলছে সহায়ক উপকরণ দিয়ে। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে কোচিং ও প্রাইভেট। সরকারি পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ছাপা হচ্ছে বেসরকারি বই অর্থাৎ গাইডবই। শিক্ষার সব স্তরেই এসব বিরাজ করছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মূল পাঠ্যবই সহায়ক গাইডবইয়ে বাজার সয়লাব। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে বাজারে গাইডবইয়ের রাজত্ব চলছে।
প্রস্তাবিত আইনে নোটবই বা গাইডবই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নোটবই বা গাইডবই বলতে সরকার অনুমোদিত সহায়ক পুস্তক বাদে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লেখা থাকে যেসব পুস্তকে এবং যা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য প্রকাশ করা হয় সেগুলো বোঝানো হয়েছে।
সহায়ক বই বা গাইডবই ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সহায়ক হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক তথা স্থানীয় পুস্তক ব্যবসায়ীরা এর অপব্যবহার করেন। অনেক সময় স্কুল কর্তৃপক্ষ বা বিষয় শিক্ষক নির্দিষ্ট গাইডবই কেনার জন্য ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেন। ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দিষ্ট বইয়ের দোকান থেকে সে বই কিনতে বাধ্য হয়। এর সঙ্গে অনেক সময় প্রকাশক, পুস্তক ব্যবসায়ী বা স্থানীয় বই দোকানদার ও শিক্ষকের যোগসাজশ থাকে। এটি সামগ্রিকভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার জন্য ক্ষতিকর।
গাইডবই থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী হয়তো কখনো মূল পাঠ্যবই খুলেও দেখে না। একটি পাঠ্য পুস্তক জাতীয় শিক্ষাক্রমের অংশ। পুরো পাঠ্যপুস্তক না পড়লে শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে না। গাইডবই তৈরি করা হয় পরীক্ষায় পাস ও ভালো ফলাফলের লক্ষ্যে। আর পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয় একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে। জাতীয় শিক্ষানীতি ও জাতি গঠন করার বৃহত্তর লক্ষ্য এর সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত।
Advertisement
কিন্তু নতুন আইনে সহায়ক বই পুরোপুরি নিষেধ করা হয়নি। সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক বই বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক বই কেনা বা পাঠে বাধ্য করতে পারবেন না। কিন্তু কথা হচ্ছে, শিক্ষকরা আগেও সরাসরি বাধ্য করেনি। শিক্ষকরা কোনো একটি বই কেনার পরামর্শ দিলে শিক্ষার্থীর সেটা কিনবে এটাই স্বাভাবিক।
শিক্ষকরা কোনো একটি বই কেনার পরামর্শ বা ইঙ্গিত দেয়াই যথেষ্ট। কাজেই, এ শর্তটি বাস্তবে কোনো কাজে আসবে না। তাছাড়া কোন শিক্ষক কোনো বই কেনার পরামর্শ দিলেন কি দিলেন না সেটা দেখভাল করার ব্যবস্থা কি? আইনে তাদের এই অসদাচরণ দেখার ও বিচার করার পদ্ধতি প্রক্রিয়া কী হবে এ বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। তবে গাইডবই প্রকাশ করতে সরকারের অনুমোদন নিতে হবে এটি ইতিবাচক।
অনুমোদিত গাইডবইয়ের তালিকা থাকলে শিক্ষার্থীরা সেই তালিকা থেকে যেটি ভালো মনে করবে সেই বই কিনতে পারবে। এতে যত্রতত্র গাইডবই প্রকাশের ওপর সরকারের একটি নজরদারি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখানেও একটি সমস্যা রয়ে গেছে। তা হলো, জাতীয় পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়েও দেশের শিক্ষাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রশ্ন রয়েছে। ছোটখাটো ভুল থেকে বড় ভুল সবই রয়েছে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড যেখানে কয়েকটি পাঠ্যবইয়ের মানই ঠিক করতে পারেনি, সেখানে তারা বিপুল সংখ্যক গাইডবইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা কীভাবে আশা করা যায়?
গাইডবই বিষয়ক বিধানগুলো কার্যকর করতে যে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার তার কোনো ব্যবস্থা আইনে নেই। শিক্ষকদের কমিশন বাণিজ্য, অনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্তি, গাইডবই ক্রয়ে শিক্ষার্থীদের বাধ্য কিংবা উৎসাহিত করার বিষয়টি তদারকিসংক্রান্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ফলে আগে গাইডবই নিষেধ ছিল। এখন এই বিধানের ফলে গাইডবই আইনসিদ্ধ করা হলো মাত্র।
দেশের সব এলাকায় শিক্ষার হার সমান নয়। সবার জন্য শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ কোনোটিই নিশ্চিত করা যায়নি। এছাড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার সুযোগও কম। রয়েছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরাও। বাস্তব কারণেই সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা কঠিন কাজ। এর সঙ্গে রয়েছে আর্থসামাজিক অবস্থার সম্পর্ক। সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে শুধু আইন দিয়ে হবে না। এজন্য যথাযথ বাজেট বরাদ্দ ও সেই বাজেট ঠিকভাবে ব্যয় হচ্ছে কি না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাইভেট পড়ানো এদেশে নতুন কিছু নয়। এটি যেন এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে মিশে আছে। একটা সময় খুব কম সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীই প্রাইভেট পড়তো। এখন এর নানামুখী বিস্তার হয়েছে। এখন ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলের চেয়ে প্রাইভেট পড়ার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দেয়। শিক্ষকরাও তাই। এজন্য শিক্ষক তথা স্কুল কর্তৃপক্ষ যেমন দায়ী তেমনি শিক্ষার্থী-অভিভাবকরাও সমান দায়ী। ফলে এটি যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে।
প্রস্তাবিত আইনে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। এই বিধানের যথাযথ প্রয়োগ করা গেলে প্রাইভেট পড়ানো কমবে বলেই মনে হয়। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়- কোন শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন এটা মনিটর করবে কে? আবার আইনে বলা আছে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক নির্ধারিত ক্লাসের বাইরেও অতিরিক্ত ক্লাস নিতে পারবেন।
‘ক্লাসের বাইরে অতিরিক্ত ক্লাস’, ‘পিছিয়ে পড়া ছাত্র-ছাত্রী’- এ বিষয়গুলো নির্ধারিত হবে কিসের ভিত্তিতে? কে নির্ধারণ করবে? এছাড়া এসব অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য তিনি কোনো টাকা-পয়সা নিতে পারবেন না বলেও আইনে বলা আছে। কে টাকা নিয়েছে আর কে টাকা দিয়েছে এটাই বা কে বলবে? বিধানগুলো ইতিবাচক সন্দেহ নেই। কিন্তু বাস্তবায়ন নিয়েই সংশয়।
খসড়া আইন বলছে, শিক্ষকরা নিজের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতে না পারলেও তারা কোচিং সেন্টারে পাঠদান করতে পারবেন। কিন্তু কোচিং সেন্টারের কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে পাঠদান করতে পারবেন না। তার মানে শিক্ষকরা কোচিং সেন্টারে অন্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিতে পারবেন, কিন্তু নিজ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিতে পারবেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়ম কোচিং সেন্টারগুলো কীভাবে মেনে চলবে? কোচিং সেন্টারগুলো কি স্কুলভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করবে? কোচিং সেন্টার এ বিধান মেনে চলছে কি না তা-ই বা কে ও কীভাবে নিশ্চিত করবে?
কোচিং সেন্টার বন্ধ করার জন্য অনেক দাবিদাওয়া থাকলেও সরকার তা বন্ধ করতে পারেনি। উল্টো এখন আইন করে কোচিং সেন্টারের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। নিবন্ধন নিয়ে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা যাবে। এটি মন্দ নয়। কিন্তু কী মানদণ্ডের ভিত্তিতে কোচিং সেন্টার নিবন্ধন দেওয়া হবে তার বিস্তারিত নেই। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান দেখাশোনারই কেউ নেই, সেখানে কোচিং সেন্টারের মান নিয়ন্ত্রণ ও দেখাশোনা কে করবে? কাজেই, আইনের মাধ্যমে কোচিং সেন্টারকেই বৈধতা দেওয়া হলো।
শিক্ষা এদেশে একটি বড় বাণিজ্য। বাণিজ্যিক কারণেই খেয়ালখুশি মতো স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। খসড়া আইন বলছে, সরকারের অনুমতি ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। আইন আরও বলছে, বাংলাদেশি কারিক্যুলামে বিদেশে প্রতিষ্ঠান স্থাপনেও অনুমতি লাগবে। এর সঙ্গে জাতীয় শিক্ষা, কারিক্যুলাম ও জাতীয় শিক্ষা নীতির সম্পর্ক রয়েছে। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার আগে সরকারের অনুমতি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
দেশের স্কুল-কলেজগুলোর বেতনের কোনো নিয়মনীতি নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো খেয়ালখুশি মতো বেতন নেয় বলে অভিযোগ আছে। আইন অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অযৌক্তিক ও উচ্চহারে বেতন ও টিউশন বা অন্য ফি আদায় করতে পারবে না। কিন্তু কিসের ওপর ভিত্তি করে বেতন নির্ধারণ ও আদায় করা হবে এর কোনো মানদণ্ড আইনে নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মতোই ফি আদায় করতে থাকবে।
এছাড়া প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পরিপন্থি এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কার্যক্রম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা করা যাবে না। কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এ কারণে ইতোপূর্বে আরও কয়েকটি আইনের অপপ্রয়োগের প্রবণতা আমরা দেখেছি। শিক্ষাক্ষেত্রেও এসব বিষয়গুলোর অপব্যবহার হলে সেটি হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
কাজেই শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়েই একটি আইন হচ্ছে। এটি ইতিবাচক। কিন্তু আইনের ইতিবাচক ফলাফল ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে বেশ কয়েকটি বিধানের পূর্ণাঙ্গতা প্রয়োজন। সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা প্রয়োজন। বিভিন্ন বিষয়ে মানদণ্ড ও বিধিবিধান প্রণয়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জিকেএস