দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য মুদ্রানীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এগিয়ে যাবে দেশ। মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা, যেন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এছাড়া মুদ্রাবিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখাও মুদ্রানীতির অন্যতম কাজ।
Advertisement
কিন্তু বর্তমানে মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে শহর থেকে গ্রাম, কমছে টাকার মানও। গ্রামীণ এলাকায় মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের দাম শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। যার মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে বেশি।
আরও পড়ুন>> সব রেকর্ড ভেঙে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.৩৭ শতাংশ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন অর্থাৎ ১৭ মাস শহরের থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। চলতি (২০২১-২২) অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু তা ছাড়িয়ে গেছে। গত (২০২০-২১) অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। চলতি অর্থবছর পর পর তিন মাস গ্রামে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে। যেখানে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে ছিল। মার্চে শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ সময় গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ ও শহরে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। একই সময়ে গ্রামে ছিল ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া মার্চে ভোক্তা মূল্যসূচকের (সিপিআই) হালনাগাদ তথ্যে এমনটা বলা হয়েছে।
Advertisement
সিপিআইয়ের হালনাগাদ তথ্যমতে, গত বছরের জুনের তুলনায় চলতি বছরের জুনে সারাদেশের ভোক্তা মূল্যসূচকের হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে গ্রামে বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং শহরে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের জুনে যেসব পণ্য ও সেবা কিনতে ২৭৬ টাকা ১২ পয়সা খরচ করতে হতো, একই পণ্য ও সেবা পেতে জুনে খরচ করতে হয়েছে ২৯১ টাকা ৭০ পয়সা। আলোচ্য সময়ে খরচ বেড়েছে ১৫ টাকা ৫৮ পয়সা। এর মধ্যে গ্রামে বেড়েছে ১৫ টাকা ৯৮ পয়সা। শহরে বেড়েছে ১৪ টাকা ৯২ পয়সা। জীবনযাত্রার সূচকে শহরের চেয়ে গ্রামে ব্যয় বেড়েছে ১ টাকা ৬ পয়সা।
আরও পড়ুন>> নতুন চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি ও ডলার রেট: গভর্নর
বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে শহরে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, সেখানে গ্রামে বেড়ে ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, গ্রামে ছিল ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। মার্চে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, শহরে কমে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এপ্রিলে শহরে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মে মাসে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ, গ্রামে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে শহরে ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, গ্রামে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে শহরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে ছিল ৫ শতাংশ। এরপর থেকেই চিত্র উল্টে যায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে এবং শহরে কমতে থাকে। ওই সময় থেকে ২০২২ সালের জুন অর্থাৎ ১৭ মাস শহরের থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। গ্রাম ও শহরের মানুষের আয় বৈষম্য অনেক। শহরের থেকে গ্রামের মানুষের আয় কম।
Advertisement
গ্রাম ও শহরের মূল্যস্ফীতির পার্থক্য প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটার একটি গাণিতিক কারণ আছে— একটি পণ্যের দাম এক জায়গায় ৫০ টাকা, আরেক জায়গায় ৭০ টাকা। ধরি, দুই জায়গায় দুই টাকা বাড়লো। তাহলে দুইকে ৫০ দিয়ে ভাগ (২/৫০) করলে যে পার্সেন্টেজ দাঁড়াবে, দুইকে ৭০ দিয়ে ভাগ (২/৭০) করলে পার্সেন্টেজ কম হবে। সাধারণভাবে গ্রামের তুলনায় শহরে পণ্যের স্তরটা বেশি। পণ্য সাধারণত শহরের বাইরে থেকে আসে। এখানে একটা সাপ্লাই চেন আছে। যেহেতু শহরে স্তরটা বেশি সেই হিসাবে একই হারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও গ্রামে রিফ্লেকশন বেশি দেখাবে। কারণ আমরা একই পণ্যকে এক জায়গায় ৫০ দিয়ে ভাগ দিচ্ছি, আরেক জায়গায় ৭০ দিয়ে ভাগ দিচ্ছি। এটা একটা গাণিতিককার।
আরও পড়ুন>> আরও ৫০ পয়সা কমেছে টাকার মান
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পদ্মা সেতুসহ রাস্তাঘাটের যে উন্নয়ন হচ্ছে বা হয়েছে পার্থক্যটা আরও কম হওয়া দরকার। কারণ এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতে সময় কম লাগছে। সেই হিসেবে মূল্যস্ফীতির পার্থক্যটা আরও কম হওয়া দরকার। এর শটকার্ট উত্তর নেই— গবেষণা দরকার। গ্রামে ক্রয়ক্ষমতা কম। গ্রামে কাপড় লন্ড্রি করতে যে খরচ হয়, শহরে কিন্তু তার থেকে বেশি। গ্রামে মূল্য স্তরটা কম। গ্রামে ৩৭৭টি পণ্যের আইটেম থেকে মূল্যস্ফীতির তথ্য বের করা হয়, শহরে ৪৭০টি পণ্যের আইটেম থেকে মূল্যস্ফীতির তথ্য বের করা হয়। গ্রাম ও শহরের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার কম হওয়া দরকার।’
মূল্যস্ফীতির হারের এ উল্টো স্রোতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। শহরে খাদ্যের বড় অংশের জোগান আসে গ্রাম থেকে। এ কারণে গ্রামের চেয়ে শহরে খাদ্য উপকরণের দাম বেশি হারে বাড়ার কথা। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হারও গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে গ্রামেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। এটা কেন হলো- তা খতিয়ে দেখা দরকার।
বর্তমান সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বেড়েছে। শহরের থেকে গ্রামের মানুষ খাদ্যখাতে বেশি টাকা ব্যয় করে বলেই শহরের থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি দাবি অর্থনীতিবিদদের।
আরও পড়ুন>> কাটবে খাদ্য সংকট, কমবে মূল্যস্ফীতি
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, মূলত খাদ্যের দাম বেশি বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার বড় অংশই খাদ্যপণ্যে। গ্রামের মানুষ খাবারের জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করে। শহরে ধনী ও বিত্তবানদের বাস বেশি। তারা খাদ্যখাত থেকে খাদ্যবহির্ভূত খাতে বেশি ব্যয় করে। তবে, খাদ্যবহির্ভূত খাতে দাম বেশি বাড়েনি। খাদ্যে দাম বাড়লেও গ্রামের ১০০ টাকা আয় করলে ৮০ টাকা খাদ্যে খরচ করে। অন্যদিকে, শহরের মানুষ ২০০ টাকা আয় করলে ১৬০ টাকা কিন্তু খাদ্য খাতে খরচ করে না। দেখা যায়, তারা বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ করে।’
বিবিএস জানায়, সর্বশেষ জুনে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এসময় শহরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ অথচ গ্রামে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ সময় যত গড়াচ্ছে ততই শহর থেকে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে।
এমওএস/এমএএইচ/এসএইচএস/জিকেএস