ভালোভাবে কোন কিছু না দেখে, না জেনে, না বুঝে মন্তব্য করা পুরনো অভ্যেস-আমাদের। মন্তব্য করতে কিছু ভাবতে হয় না, কোন দায়িত্বও নিতে হয় না। যে কারও সর্ম্পকে, যে কোন কিছু সম্পর্কে মন্তব্য করলেই হল। ব্যক্তি, প্রেক্ষাপট, বিষয়, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, পেশাদারিত্ব, সামাজিক প্রভাব কোনো কিছু বিবেচনায় আনার প্রয়োজন হয় না অমূলক মন্তব্য করতে।
Advertisement
সোশ্যাল মিডিয়া পুরোটাই এক অনিয়ন্ত্রিত বাজার। অনেকটা কারওয়ান বাজার আর লাঠিয়াল বাহিনীর অদ্ভুত মিশেল। জোর যার মুল্লুক তার চরিত্র। কারো সম্পর্কে কোন অপ্রচার করতে চাও, বাহিনী লেলিয়ে দাও, ছড়িয়ে দাও অপবাদের বিষবাষ্প। ভালোমন্দ, উচিত অনুচিত দেখার সময় নেই, গুজব হলে আরো গ্রোগ্রাসে খাও, রীতিমতো গিলো।
বাংলা ছবি ভালো না, ক্ষেত, আনস্মার্ট, মফস্বল আবার এখন বলা হচ্ছে নকল। আমি গাল দিচ্ছি কিন্তু আমার নিজেকে। নিজের দেশের ছবি নিজের পরিচয়। আমার যা সেটাই আমি। অন্যের শতকোটি ভাল, অবশ্যই ভালো কিন্তু তা আমার নিজের নয়।
আমাদের ভালো ছবির দারুণ অতীত আছে। অতীত যখন আছে, অভিজ্ঞতা আছে, ঋদ্ধতা আছে, ফলে ভবিষৎও আছে নিশ্চয়ই। বহুকাল আগেই এদেশের ছবি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসিত পুরস্কৃত হয়েছে। কাজী হায়াতের প্রথম ছবি ‘দি ফাদার’ বহুকাল আগেই কাল আগে কান ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিল।
Advertisement
আলমগীর কবীরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ছবিই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা কুড়িয়েছে। জহির রায়হানে ‘স্টপ জেনোসাইড’ সাড়া ফেলেছে বিশ্বে। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ তো কান ফ্যাস্টিভ্যালে পুরস্কার জিতেছে।
আমি ছবির কোন বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক ধারা, স্বল্প দৈর্ঘ্য-পূর্ণ দৈর্ঘ্যে বিশ্বাসী নই। সে যার মতো গল্প করতে, বলতে, চিত্রায়ন করতে পারে। সেই চিত্রায়ন কতটা কমিউনিকেটিভ সেটা বিবেচ্য।
কোভিড পরিস্থিতি সারা দুনিয়াকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ফেলেছে। ছবির বাজার সারা দুনিয়াতে প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। শুটিং বন্ধ, ছবি বন্ধ, হল বন্ধ ছিল শুধু এখানে নয়, সারা বিশ্বে। তার উপর আমাদের ছবি মন্দা, বন্ধ্যা সময় পার করছে কয়েকবছর যাবত। সেখানে ‘দিন দ্যা ডে’, ‘পরান’ বা ‘হাওয়া’ ছবিগুলো হাউজফুল যাওয়া, ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন হাওয়া নিঃসন্দেহে।
আগেই বলেছি ট্রল করতে, অন্যকে নিয়ে হাস্যরস করতে, টিটকারী করতে, তামাশা করতে, রঙ্গরস করতে কোন দায়িত্ব নিতে হয় না। দায়িত্বের অংশও হতে হয় না। অনন্ত জলিলকে নিয়ে ট্রল হয় নিয়মিত। কিন্তু তিনি যে ছবির বাজার বাঁচাতে নিজের টাকা বিনিয়োগ করে, চেষ্টা করে যাচ্ছেন তা কি আমরা মনে রাখি?
Advertisement
আমি বলছি না অনন্ত খুব ভালো অভিনেতা, সবাই দুর্দান্ত ক্লাসিক অভিনেতা হবেন সেটা আশা করাও বোকামি। কিন্তু তিনি যে ছবি নির্মাণ করেছেন নিজের দেশের মানুষকে কাজে লাগিয়ে; সেই চেষ্টা আর বিনিয়োগের প্রতি সম্মান রাখা উচিত।
বলা হচ্ছে মিজবাউর রহমান সুমনের ‘হাওয়া’, ‘দি ফগে’র নকল। যারা এই মন্তব্য করেছেন তারা ছবি না দেখেই করছেন। মনে রাখতে হবে ছবি কিন্তু বাস্তবের চিত্রায়ন বা দৃশ্যায়ন নয়, ছবি ছবিই। বলা হয় ‘ইমিটেশন অব লাইফ’। জীবনের অনুকৃতি। ফিল্মে ফিল্মিক বিষয় থাকবেই।
নায়িকা বা নায়ক একই গানে ১৯ বার পোশাক বদলাবেন। কোথায়, কিভাবে গিয়ে পোশাক বদল করলো ফিল্ম তা দেখাবে না। এখানেই ফিল্ম আর ডকুমেন্টারির পার্থক্য। যারা ফিল্মের মধ্যে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস খুঁজছেন তারা দয়া করা ফিল্ম না দেখে নোয়াম চমস্কি, এডওয়ার্ড সাঈদ বা অরুন্ধতী রায় পড়ুন।
একটা ফিল্ম কিন্তু শুধু একটা ফিল্ম না। নায়ক নায়িকা না, শুধু গ্লামার না, দু-একটা নাচ গান তাও না। একটা ফিল্ম বহু মানুষের, বহু শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবিকা। এর সঙ্গে অনেক লিংকেজ ইন্ড্রাস্টিজ জড়িত। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়। কেউ এখানে খাবার সাপ্লাই দেয়, কেউ ক্যামেরা লাইট দেয়, কেউ পরিবহনের গাড়ির সঙ্গে যুক্ত, কেউ পোশাক সরবরাহ করে, পোশাকের ডিজাইন করে, শুটিংয়ের বাড়ি ভাড়া দেয় অনেকে, কেউ কেউ মোশন গ্রাফিক্সের কাজ করে, কেউ এডিটিং, কেউ ভিএফএক্স, কালার, হলের ব্যবসা আরও কত কী! হয়তো কোন একটি লোক বাদাম বিক্রি করে হলের সামনে- এটাই তার জীবিকা, মনে রাখতে হবে।
আমরা বড় আত্মঘাতি। নিজের পায়ে কুড়াল মারি। খাল কেটে হাঙ্গর আনি। বহু লোক ফেসবুকে সারাক্ষণ স্ট্যাটাস দিচ্ছে ‘দেশ শ্রীলংকা হলো হলো’, মনে হয় তারা শ্রীলংকা হবার জন্য প্রার্থনারত। অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্যই করবো তবে নিজের অমঙ্গল নিশ্চিত করে নয় নিশ্চয়ই।
আমার দেশ, মাটি, আমার পরিচয়, যেখানেই যাই, যে দেশেই থাকি। আজকে বাংলাদেশের ছবির বাজার নষ্ট হলে বুঝতে হবে কার লাভ কার ক্ষতি? নিজেদের ক্ষতি নিজেরা করলে, অন্যেরা তাতে ঘি ঢালবে। আপনার ট্রলে লাইক, কমেন্টেসের বন্যা বয়ে যাবে। তাতে আপনার বা আমার লাভ কী!
লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা, সদস্য ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস