শ্রীলঙ্কার করুণ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে পাকিস্তানি গণমাধ্যমও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। সেই উদ্বেগই ধরা পড়েছে ২২ জুলাই প্রকাশিত পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে।
Advertisement
ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিম সাজ্জাদ আখতার নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আইএমএফ, সৌদি আরব অথবা অন্যান্য দাতারা কয়েক বিলিয়ন ডলার না দিলে পাকিস্তান কি আসলেই খেলাপি হবে?’ আর এই প্রশ্নের উত্তরও উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতেই। সেখানে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে পাকিস্তানের শ্রীলঙ্কা হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামাবাদে অনেকেই বিপদ ঘণ্টা বাজাতে শুরু করে দিয়েছেন। তারা বুঝতে পারছেন বিপদ বেশি দূরে নেই। কিন্তু সরকার ও সরকারের তোষামোদকারীরা অভয় দিয়ে চলেছেন, শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানি অর্থনীতির জাহাজ সহজে ডুববে না। ফলে এখনই নাকি ভয়ের কিছু নেই। তবে সরকারের আশ্বাসবাণীতে আস্থা কমছে বেশিরভাগ পাকিস্তানবাসীর।
ইসলামাবাদের পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমা দুনিয়া, ইসলামিক রাষ্ট্রগুলো অথবা চীন পাকিস্তানকে দেউলিয়া রাষ্ট্র হওয়ার থেকে কতোটা রক্ষা করতে পারবে তা নিয়ে ডনের সন্দেহ রয়েছে। পত্রিকার মতে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাপক দুর্নীতি ও বর্ষার বৃষ্টিপাতের প্রাণঘাতী সংমিশ্রণ পাকিস্তানকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ৯ কোটি পাকিস্তানি এখনই ক্ষুধার্ত। দেশবাসীকে অনাহার আর অর্ধাহার থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ পাকিস্তানের দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সরকার।
Advertisement
অধ্যাপক আসিম লিখেছেন, ‘বিপদ সামনে এলেও আমাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে আমাদের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো খারাপ হবে না। এই ধরনের অলঙ্কৃত বিবৃতি দেওয়ার সময় রাজনৈতিক ও মূলধারার বুদ্ধিজীবীরা ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে শ্রীলঙ্কার মতোই ছলনার সাহায্য নিচ্ছেন। সেই দ্বীপ দেশটির মতো, পাকিস্তানও একটি জাতিগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দ্বারা পরিচালিত দেশ। এখানেও প্রান্তিক ও সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক প্রজাদের মতো আচরণ করা হয়।’ তিনি এবিষয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পাকিস্তানের সঠিক তুলনা টানেন।
ডনে উল্লেখ করা হয় সিংহলিদের জাফনা দখলের কথাও। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘ব্রিটিশরা ১৯৪৮ সালে সাবেক সিংহল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে শ্রীলঙ্কার তামিল সংখ্যালঘুরা সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে নিয়মতান্ত্রিক এবং পদ্ধতিগত বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন। সম্প্রতি অবশ্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাজাপাকসেদের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহে সকলেই সামিল হন। কিন্তু রাজাপাকসে ভাইয়েরা ২০০৯ সালে তামিল-সংখ্যাগরিষ্ঠ জাফনা প্রদেশে বর্বরোচিত সামরিক অভিযানে সাফল্য এনে দেওয়ায় তখন সিংহলিরা কিন্তু উৎসবে মেতে ছিলেন। সেই ক্ষত কিন্তু আজও ভোলেননি তামিলরা। তাই দেশ-বিদেশের অনেক শ্রীলঙ্কানই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ সাধারণ সিংহলী ও তামিলদের সাময়িকভাবে সংঘবদ্ধ দেখালেও সহিংসতার শিকার তামিলদের সঙ্গে সিংহলিদের সখ্য কিছুতেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।’
পত্রিকাটিতে পাকিস্তানের উদাহরণ টেনে তুলে ধরা হয়েছে প্রান্তিক ও সংখ্যালঘুদের ওপর মূলধারার বর্বরোচিত আক্রমণের কথা। অধ্যাপক আসিম লিখেছেন, ‘পাকিস্তানে আমরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন নিয়ে কোনও প্রশ্নই করতে পারি না। প্রকৃতপক্ষে, দেশের মূলধারা আমাদের অনেক জাতিগত বর্বরতা ও ঘৃণার চলমান প্রক্রিয়াগুলিকে অবাধে চালিত করছে। জিয়ারতে সম্প্রতি ১০টি বিকৃত মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা নিহতদের বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি হিসাবে বর্ণনা করেছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার যখন মৃতদের মধ্যে কয়েকজনকে শনাক্ত করে শান্তিপূর্ণভাবে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে কোয়েটায় জড়ো হন তখন তাদের ওপর লাঠিচার্জ করা হয়। বিচারের বদলে নিক্ষেপ করা হয় কাঁদানে গ্যাস।’
বেলুচদের করুণ পরিস্থিতির কথাও তুলে ধরা হয় ওই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ‘বেলুচদের অবস্থা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রকল্পের ধারণাকে অনেক আগেই ভুল প্রমাণ করেছে।’
Advertisement
ডন-এর মতে, ‘সমস্ত জাতি ও জনজাতির মধ্যে সমতা নিশ্চিত করে পুরনো দিনের যাবতীয় সামাজিক ক্ষত মেরামত করা হলেই রাষ্ট্র আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’ কিন্তু সেই ক্ষত মেরামতের কোনও লক্ষণই পাকিস্তানে নেই।
পত্রিকাটির সাফ কথা, ‘ঘৃণা সত্যিই সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদে একটি হত্যাকাণ্ডের পর সিন্ধু এবং পাখতুনদের মধ্যে যে জাতিগত উত্তেজনা এবং সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা স্পষ্ট করে দেয় যে বিভক্ত ও শাসন নীতি সফলভাবে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতি প্রগতিশীল কণ্ঠকেও আচ্ছন্ন করতে বাধ্য।’
প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে, ‘বহুকাল ধরে মূলধারার দলগুলো পাকিস্তানের জন্য বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করছে না। সরকারে থাকতে বা সরকারে ফেরার পথ খুঁজতেই রাজনৈতিক দলগুলি বেশি আগ্রহী। পাঞ্জাবের সাম্প্রতিক উপ-নির্বাচনগুলিতে দেখা গিয়েছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রে দৈনন্দিন রাজনীতি জাতিগত পরিধির সাথে প্রায় সম্পূর্ণভাবে সংযোগহীন। পিটিআই, পিডিএম, পিপিপি এবং অবশ্যই, সামরিক সংস্থাগুলি ক্ষমতা দখলের জন্য সংখ্যাগুরুদেরই তোষণ করে চলেছে। ক্ষমতা দখলই তাদের একমাত্র লক্ষ্য।’
পাকিস্তানি গণমাধ্যমটির মতে, ‘বর্তমান সরকার এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা এখন অবশ্যই আইএমএফ, সৌদি আরব এবং অন্যান্য দাতাদের খুশি রাখার জন্য যথেষ্ট সময় এবং শক্তি উৎসর্গ করবে। কারণ বিকল্প পরিস্থিতি সমগ্র গোষ্ঠীরই ক্ষমতা এবং সম্পদের সঞ্চয়কে হুমকির মুখে ফেলেছে।’
অধ্যাপক আসিম ইমরান খানের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সাবেক পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকরা বিশ্বাস করেন যে ন্যূনতম ঐকমত্যও ভেঙে চুরমার হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, ‘সামরিক শাসক শ্রেণির একতা কি এখনও অক্ষত রয়েছে? পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির ভূমি দখলকারী, যুদ্ধ প্রস্তুতকারী এবং মুনাফাখোর মনোভাবের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জাতিগত বিদ্বেষ এবং ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিরও কড়া সমালোচনা করা হয়।’
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যদি পাকিস্তান দেউলিয়া ঘোষিত হয় তাহলে তার বোঝা আবারও শ্রমজীবী জনগণকেই বহন করতে হবে বলেও সতর্ক করে দিয়েছে ডন। অধ্যাপক আসিমের কথায়, ‘সত্যিই আমরা ইতিমধ্যেই একটি খেলাপি দেশে পরিণত হয়েছি এবং শুধু ঘৃণাকে অতিক্রম করার পাশাপাশি সম্পদ পুনঃবন্টন করার দৃষ্টিভঙ্গিই পারে আমাদের নতুন করে গঠন করতে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মধ্যে এখনও যথেষ্ট সক্ষম এবং অর্থপূর্ণ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকল্প পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অতি দ্রুত এমন একটা সময় আসবে, যখন এই ধরনের সুযোগ থাকবেনা। তখন খুব দেরি হয়ে যাবে।’
সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল সরকারের শাসনকালে পাকিস্তানি গণমাধ্যমই যখন এমন আশঙ্কার কথা শোনাচ্ছে তখন মানতেই হবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। চীনা ঋণের ফাঁদ আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও আধিপত্যবাদীদের দাপটে পাকিস্তান শিগগিরই দেউলিয়া ঘোষিত হতে চলেছে। শ্রীলঙ্কার মতোই চীনা ঋণের ফাঁদ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে ইসলমাবাদকে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কার মতোই অভ্যন্তরীণ জাতিবিদ্বেষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘পাকিস্তান সরকারের ঔপনিবেশিক ও দমনমূলক মানসিকতা পতনকে আরও ত্বরান্বিত করছে। বহু দাতা দেশও আজ ইসলামাবাদের ওপর বিরক্ত। ফলে শ্রীলঙ্কার ছায়া প্রকট হচ্ছে পাকিস্তানে, পরিত্রাণের পথও সংকীর্ণতর হচ্ছে দিন দিন।’
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস